৯-১০ নং আয়াতের তাফসীর: এখানে আল্লাহ তা'আলা নির্দেশ দিচ্ছেন যে, যদি মুসলমানদের দুই দল পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে তবে অন্যান্য মুসলমানদের উচিত তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়া। পরস্পর বিবাদমান দু’টি দলকে মুমিনই বলা হয়েছে। ইমাম বুখারী (রঃ) প্রমুখ গুরুজন এটাকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে বলেন যে, কোন মুসলমান যত বড়ই নাফরমান হোক না কেন সে ঈমান হতে বের হয়ে যাবে না, যদিও খারেজী, মু'তাযিলা ইত্যাদি সম্প্রদায় এর বিপরীত মত পোষণ করে। নিম্নের হাদীসটিও এ আয়াতের পৃষ্ঠপোষকতা করেঃহযরত আবু বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) মিম্বরের উপর ভাষণ দিচ্ছিলেন এবং তাঁর সাথে হযরত হাসান ইবনে আলী (রাঃ)-ও মিম্বরের উপর ছিলেন। কখনো তিনি হযরত হাসান (রাঃ)-এর দিকে তাকাচ্ছিলেন এবং কখনো জনগণের দিকে দেখছিলেন। আর বলছিলেনঃ “আমার এ ছেলে (নাতী) নেতা এবং আল্লাহ তা'আলা এর মাধ্যমে মুসলমানদের বিরাট দু’টি দলের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দেবেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে। সিরিয়াবাসী ও ইরাকবাসীদের মধ্যে বড় বড় ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পর তাঁরই মাধ্যমে তাদের মধ্যে সন্ধি হয়। এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ যদি একদল অন্য দলের উপর বাড়াবাড়ি করে এবং তাদেরকে আক্রমণ করে বসে তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। সহীহ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে অত্যাচারী হোক অথবা অত্যাচারিত হোক।” বর্ণনাকারী হযরত আনাস (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি সাহায্য করতে পারি অত্যাচারিতকে, কিন্তু আমি অত্যাচারীকে কিরূপে সাহায্য করতে পারি?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “অত্যাচারীকে তুমি অত্যাচার করা হতে বাধা দিবে ও বিরত রাখবে, এটাই হবে তোমার তাকে সাহায্য করা।”হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা নবী (সঃ)-কে বলা হয়ঃ “যদি আপনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর নিকট একবার যেতেন!” অতঃপর নবী (সঃ) গাধার উপর সওয়ার হয়ে চললেন এবং মুসলমানরাও তাঁর সাথে চলতে লাগলেন। যখন তারা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর নিকট পৌঁছেন তখন সে নবী (সঃ)-কে বলেঃ “আপনি আমা হতে দূরে থাকুন। আল্লাহর কসম! আপনার গাধার গন্ধ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তার একথা শুনে আনসারদের একজন লোক তাকে বললেনঃ “আল্লাহর শপথ! তোমার গন্ধের চেয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর গাধার গন্ধ বহুগুণে উত্তম ও পবিত্র।” তাঁর একথা শুনে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর কতক লোকে ভীষণ রেগে গেল এবং এরপর উভয় দলের প্রত্যেক লোকই রাগান্বিত হলো। অতঃপর অবস্থা এতদূর গরালো যে, তাদের মধ্যে হাতাহাতি ও জুতা মারামারি শুরু হয়ে গেল। তাদের ব্যাপারে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারীতেও এটা বর্ণিত হয়েছে)হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) বলেন যে, আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে কিছু ঝগড়া-বিবাদ হয়েছিল। তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার হুকুম এই আয়াতে রয়েছে।হযরত সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, ইমরান নামক একজন আনসারী ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম ছিল উম্মে যায়েদ। তিনি (তাঁর স্ত্রী) তার পিত্রালয়ে যেতে চান। কিন্তু তার স্বামী বাধা দেন এবং বলে দেন যে, তাঁর স্ত্রীর পিত্রালয়ের কোন লোক যেন তার বাড়ীতে না আসে। স্ত্রী তখন তাঁর পিত্রালয়ে এ খবর পাঠিয়ে দেন। খবর পেয়ে সেখান হতে লোক এসে উম্মে যায়েদকে বাড়ী হতে বের করে এবং সাথে করে নিয়ে যাবার ইচ্ছা করে। ঐ সময় তাঁর স্বামী বাড়ীতে ছিলেন না। তাঁর লোকে তার চাচাতো ভাইদেরকে খবর দেয়। খবর পেয়ে তারা দৌড়িয়ে আসে এবং স্ত্রীর লোক ও স্বামীর লোকদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যায় এবং মারামারি ও জুতা ছুঁড়াছুঁড়িও হয়। তাদের ব্যাপারে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) উভয়পক্ষের লোকদেরকে ডেকে তাদের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমরা দুই দলের মধ্যে ন্যায়ের সাথে ফায়সালা করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালবাসেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “দুনিয়ায় ন্যায়-বিচারকারীরা পরম দয়ালু, মহিমান্বিত আল্লাহর সামনে মণি-মুক্তার আসনে উপবিষ্ট থাকবে, এটা হবে তাদের দুনিয়ায় ন্যায়-বিচার করার প্রতিদান।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “ন্যায়-বিচারকারীরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ডান দিকে নূরের আসনে উপবিষ্ট থাকবে। তারা তাদের হুকুমে, পরিবার পরিজনের মধ্যে এবং যা কিছু তাদের অধিকারে ছিল সবারই মধ্যে ন্যায়ের সাথে বিচার করতো।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ “মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।' অর্থাৎ মুমিনরা সবাই পরস্পর দ্বীনী ভাই। সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ ততক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করতে থাকেন যতক্ষণ বান্দা তার (মুমিন) ভাইকে সাহায্য করতে থাকে।” সহীহ হাদীসে আরো রয়েছেঃ যখন কোন মুসলমান তার (মুসলমান) ভাই এর অনুপস্থিতিতে তার জন্যে দুআ করে তখন ফেরেশতা তার দুআয় আমীন বলেন এবং বলেনঃ আল্লাহ তোমাকেও অনুরূপই প্রদান করুন।" এই ব্যাপারে আরো বহু সহীহ হাদীস রয়েছে। আরো সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “মুসলমানের পরিস্পরিক প্রেম-প্রীতি, দয়া-সহানুভূতি ও মিলামিশার দৃষ্টান্ত একটি দেহের মত। যখন কোন অঙ্গে ব্যথা হয় তখন গোটা দেহ ঐ ব্যথা অনুভব করে, সারা দেহে জ্বর এসে যায় এবং সারা দেহ জেগে থাকার (অর্থাৎ ঘুম না আসার) কষ্ট পায়।" অন্য সহীহ হাদীসে আছেঃ “এক মুমিন অপর মুমিনের জন্যে একটি দেয়ালের মত, যার একটি অংশ অপর অংশকে শক্ত ও দৃঢ় করে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার এক হাতের অঙ্গুলিগুলোকে অপর হাতের অঙ্গুলিগুলোর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেখিয়ে দেন।হযরত সাহল ইবনে সা'দ সায়েদী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মুমিনের ঈমানদারের সাথে ঐ সম্পর্ক রয়েছে, যে সম্পর্ক মাথার দেহের সাথে রয়েছে। মুমিন ঈমানদারের জন্যে ঐ ব্যথা অনুভব করে যে ব্যথা অনুভব করে দেহ মাথার জন্যে (অর্থাৎ মাথায় ব্যথা হলে যেমন দেহ তা অনুভব করে, অনুরূপভাবে এক মুমিন ব্যথা পেলে অন্য মুমিনও তার ব্যথায় ব্যথিত হয়)।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)অতঃপর আল্লাহ পাক বলেনঃ ‘সুতরাং তোমরা তোমাদের ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে সন্ধি স্থাপন কর।' অর্থাৎ বিবাদমান দুই ভাইয়ের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দাও। আর সমস্ত কাজ-কর্মের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে চল। আর এটা এমন বিশেষণ যার কারণে তোমাদের উপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হবে। যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে তাদের সাথেই আল্লাহর রহমত থাকে।