২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
সমগ্র কুরআনের কোথাও আল্লাহ তা‘আলা নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নাম নিয়ে আহ্বান করেননি বরং তাঁর গুণাবলী ও পদবীর মাধ্যমে আহ্বান করেছেন, যেমন
(يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ, يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ)
ইত্যাদি। কিন্তু অন্যান্য নাবীদের ক্ষেত্রে তাদের নাম ধরে আহ্বান করেছেন যেমন
(يَا إِبْرَاهِيمُ, يَا مُوسَي)
ইত্যাদি। কুরআনের মাত্র চার জায়গায় নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নাম মুহম্মাদ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে নামের পাশে তাঁর উপাধি ও পদবীও উল্লেখ করা হয়েছে যা তাঁর মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছে। এসব স্থানে তাঁর নাম উল্লেখ করার মধ্যে উপকারিতা হল হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্রে আলী (রাঃ) যখন তাঁর নাম “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” লিপিবদ্ধ করেন তখন কাফিররা এটা মিটিয়ে “মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ” লিপিবদ্ধ করতে পীড়াপীড়ি করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার আদেশে তা মেনে নেন। পরিবর্তে আল্লাহ তা‘আলা এ স্থানে বিশেষভাবে তাঁর নামের সাথে “রাসূলুল্লাহ” শব্দ কুরআনে উল্লেখ করে একে চিরস্থায়ী করে দিলেন যা কিয়ামত পর্যন্ত লিখিত ও পঠিত হবে। এ সম্পর্কে সূরা হুজুরাতে আরও আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ।
(وَالَّذِيْنَ مَعَه)
‘যারা তাঁর সাথে আছে’ অর্থাৎ সাহাবীগণ। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাতের পর সাহাবীদের প্রশংসনীয় কয়েকটি গুণাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন। কারণ প্রতিকুল পরিবেশ ও শত নির্যাতনের পরেও ঈমান ও আমলের মাধ্যমে সাহাবীরা যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন পৃথিবীর কোথাও এমন কোন ইতিহাস মেলে না। তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মাতের জন্য সাহাবীদেরকে নমুনা হিসেবে রেখে যান এবং তাদের অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সে জন্য কুরআনেও তাদের গুণাবলী ও লক্ষণাদি বর্ণনা করে তাদের অনুসরণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এস্থলে তাদের প্রথম যে গুণ উল্লেখ করা হয়েছে তা হল :
(أَشِدَّا۬ءُ عَلَي الْكُفَّارِ رُحَمَا۬ءُ بَيْنَهُمْ)
‘যারা তাঁর সাথে আছে তারা কাফিরদের ওপর কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে সহানুভূতিশীল, কোমল’ কাফিরদের মোকাবেলায় তাদের কঠোরতা সর্বক্ষেত্রেই প্রমাণিত হয়েছে। তারা ইসলামের জন্য বংশগত সম্পর্ক বিসর্জন দিয়েছেন, বদরের যুদ্ধে নিজের কাফির পিতাকে হত্যা করতে ইতস্ততবোধ করেননি। আর নিজেদের মাঝে সহানুভূতি ও আন্তরিকতার উপমা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মুহাজিররা মদীনায় হিজরত করে আসলে আনসাররা নিজেদের সম্পদে ও জায়গায় ভাগ দিয়েছেন এমনকি নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মুহাজির ভাইদের জন্য বৈধ করে দিতে কুন্ঠাবোধ করেননি।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
(یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مَنْ یَّرْتَدَّ مِنْکُمْ عَنْ دِیْنِھ۪ فَسَوْفَ یَاْتِی اللہُ بِقَوْمٍ یُّحِبُّھُمْ وَیُحِبُّوْنَھ۫ٓﺫ اَذِلَّةٍ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اَعِزَّةٍ عَلَی الْکٰفِرِیْنَ)
“হে মু’মিনগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ দীন হতে ফিরে গেলে শীঘ্রই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং যারা তাঁকে ভালবাসবে; তারা মু’মিনদের প্রতি কোমল ও কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে।” (সূরা মায়িদা ৫ : ৫৪)
দ্বিতীয় গুণ : তারা রুকু-সিজদা তথা ইবাদতে পাবন্দি।
(تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا)
‘তুমিতাদেরকে দেখবে রুকূ-সিজদারত অবস্থায় আল্লাহর মেহেরবানী ও সন্তুষ্টি তালাশে মগ্ন’ অর্থাৎ তারা বেশি বেশি সালাত আদায় করে যার অন্যতম রুকন হল রুকু ও সিজদা। তারা সালাতকে এত ভালবাসে যে, রাতে-দিনে সুযোগ পেলেই আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য সালাতে মশগুল হয়ে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(تَتَجَافٰي جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَّطَمَعًا ز وَّمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ يُنْفِقُوْنَ )
“তাদের দেহ-পার্শ বিছানা থেকে আলাদা হয়ে যায় যে, তারা তাদের প্রতিপালককে আহ্বান করতে থাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।” (সূরা সিজদাহ ৩২ : ১৬)
(سِيْمَاهُمْ فِيْ وُجُوْهِهِمْ مِّنْ أَثَرِ السُّجُوْدِ)
‘তাদের চেহারায় সিজদার আলামত রয়েছে’ হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন : এর অর্থ হল মুসল্লীদের মুখমণ্ডলের সেই নূর যা কিয়ামতের দিন প্রকাশ পাবে। একদা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমাযানের ২১ তারিখের রাতে ফজরের সালাত আদায় করলেন (রাতের বেলা বৃষ্টি হয়েছিল) ফলে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কপালে পানি ও কাদার চিহ্ন লেগে ছিল। হাসান বাসরী বলেন : কিয়ামতের দিন তা শুভ্রু হয়ে থাকবে। (সহীহ বুখারী হা. ২০১৮)
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে রয়েছে... যখন আল্লাহ তা‘আলা বান্দার মাঝে বিচার করা শেষ করবেন তখন তিনি জাহান্নামীদের মধ্য হতে যাদেরকে ইচ্ছা করবেন জাহান্নাম হতে বের করতে ফেরেশতাদের নির্দেশ দেবেন যারা “লা ইলাহা ইল্লালাহ” বলেছে কিন্তু কোন শিরক করেনি। ফেরেশতারা তাদেরকে জাহান্নামে সিজদার আলামত দেখে চিনতে পারবে, আগুন আদম সন্তানের সব কিছু খেয়ে ফেলবে কিন্তু সিজদার আলামত পুড়তে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের আগুনের জন্য সিজদার আলামত পুড়িয়ে দেয়া হারাম করে দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী হা. ৭৪৩৮, মুসলিম হা. ১৮২)
ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন : আমার কাছে এ সংবাদ এসেছে যে, খ্রিস্টানরা সিরিয়া বিজয়ী সাহাবীদেরকে দেখলে বলত- এরা মূসার অনুসারী হাওয়ারীদের থেকে উত্তম। কারণ এ উম্মাতের কথা পূর্ববর্তী কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, আর এ উম্মাতের সর্বশ্রেষ্ঠ হল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবী। আল্লাহ তা‘আলা আসামানী কিতাবে বিশেষভাবে তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা এখানে বলেছেন : তাদের উপমা রয়েছে তাওরাতে এবং তাদের উপমা রয়েছে ইঞ্জিলে। তা হল এই যে, যেমন একটি শস্যক্ষেত, যার চারাগাছগুলো অঙ্কুরিত হয়ে পরে সেগুলো শক্ত ও পুষ্ট হয় পরে তা কাণ্ডের ওপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা চাষীকে আনন্দিত করে। এমনিভাবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীগণ শুরুতে খুবই নগণ্য সংখ্যক ছিলেন। এক সময়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যতীত মাত্র তিনজন মুসলিম ছিলেন। পুরুষদের মধ্যে আবূ বকর, মহিলাদের মধ্যে খাদীজা ও বালকদের মধ্যে আলী (রাঃ)-এরপর আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এমনকি বিদায় হাজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে হাজ্জে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের সংখ্যা ছিল দেড় লক্ষাধিক। ইমাম বাগাভী বলেন : ইঞ্জিলে সাহাবায়ে কেরাম এর দৃষ্টান্ত আছে যে, তারা শুরুতে নগণ্য সংখ্যক হবে তারপর তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং শক্তি অর্জিত হবে।
এ আয়াতের ভিত্তিতেই ঈমাম মালিক (রহঃ) বলেছেন : রাফিজিরা কাফির। কারণ তারা সাহাবীদের ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করে। কেননা যারাই সাহাবীদেরকে গালিগালাজ ও বিদ্বেষ পোষণ করবে এ আয়াতের ভিত্তিতে তারা কাফির।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي، فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ أَنْفَقَ أَحَدُكُمْ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيفَهُ
তোমরা আমার সাহাবীদেরকে গালি দিও না। ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ তোমাদের কেউ যদি উহুদ পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করে তাহলেও তাদের একমুদ বা অর্ধ মুদ সমপরিমাণ ব্যায়ের সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। (সহীহ মুসলিম হা. ২৫৪০)
(لِيَغِيْظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ)
‘এভাবে আল্লাহ মু’মিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফিরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সাহাবায়ে কেরামকে উল্লেখিত গুণে গুণান্বিত করেছেন এবং তাদেরকে দুর্বলতার পর শক্তি এবং সংখ্যাস্বল্পতার পর সংখ্যাধিক্য দান করেছেন যাতে এগুলো দেখে কাফিরদের অন্তর্জ্বালা হয় এবং তারা হিংসার অনলে দগ্ধ হয়। আবূ ওরওয়া যুবায়রী (রহঃ) বলেন : একবার আমরা ইমাম মালেক (রহঃ)-এর মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। জনৈক ব্যক্তি কোন একজন সাহাবীকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কিছু বক্তব্য রাখল। তখন ইমাম মালেক অত্র আয়াতটি পূর্ণ তেলাওয়াত করতঃ যখন
(لِيَغِيْظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ)
পর্যন্ত পৌঁছলেন তখন বললেন : যার অন্তরে কোন একজন সাহাবীর প্রতি ক্রোধ আছে সে এ আয়াতের শাস্তি ভোগ করবে। (কুরতুবী)
(وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا)
‘যারা ঈমান আনে’ এখানে من অব্যয়টি বর্ণনামূলক, অর্থ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ঈমানদার ও সৎআমলকারী মু’মিনদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা দিয়েছেন তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন এবং অনেক উত্তম প্রতিদান দেবেন। এ থেকে জানা গেল সকল সাহাবী প্রকৃত ঈমানদার, তাদের সবাইকে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তাদের সবাই জান্নাতী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَالسّٰبِقُوْنَ الْأَوَّلُوْنَ مِنَ الْمُهٰجِرِيْنَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِيْنَ اتَّبَعُوْهُمْ بِإِحْسَانٍ لا رَّضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِيْ تَحْتَهَا الْأَنْهٰرُ خٰلِدِيْنَ فِيْهَآ أَبَدًا ط ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ )
“মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিুদেশে নদী প্রবাহিত হয়, যেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। এটাই হল মহাসাফল্য।” (সূরা তাওবা ৯ : ১০০)
সুতরাং সাহাবীদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা, তাদেরকে গালিগালাজ করা এবং তাদেরকে নিয়ে সমালোচনা করা ঈমানের পরিপন্থী কাজ। একজন মু’মিনের অন্তর ও মুখে সাহাবীদের ব্যাপারে ভাল ও স্বচ্ছ ধারণা থাকবে। তাদেরকে ভালবাসা ঈমান ও দীন আর তাদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা কুফরী ও মুনাফিকী।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতের স্বীকৃতি পেলাম।
২. সাহাবীদের ফযীলত জানতে পারলাম।
৩. যারা বেশি বেশি সালাত আদায় করে তাদের ফযীলত অন্যান্যদের ওপর অনেক বেশি।
৪. সাহাবীদের ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করা কুফরী, যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়।