ولا تصل على احد منهم مات ابدا ولا تقم على قبره انهم كفروا بالله ورسوله وماتوا وهم فاسقون ٨٤
وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٍۢ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَدًۭا وَلَا تَقُمْ عَلَىٰ قَبْرِهِۦٓ ۖ إِنَّهُمْ كَفَرُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَمَاتُوا۟ وَهُمْ فَـٰسِقُونَ ٨٤
وَلَا
تُصَلِّ
عَلٰۤی
اَحَدٍ
مِّنْهُمْ
مَّاتَ
اَبَدًا
وَّلَا
تَقُمْ
عَلٰی
قَبْرِهٖ ؕ
اِنَّهُمْ
كَفَرُوْا
بِاللّٰهِ
وَرَسُوْلِهٖ
وَمَاتُوْا
وَهُمْ
فٰسِقُوْنَ
۟
3

আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন মুনাফিকদের সাথে কোনই সম্পর্ক না রাখেন, তাদের কেউ মারা গেলে যেন তার জানাযার নামায না পড়ান এবং তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা বা দুআ করার উদ্দেশ্যে যেন তার কবরের কাছে না দাঁড়ান। কেননা তারা আল্লাহ ও তার রাসূল (সঃ)-এর সাথে কুফরী করেছে এবং ঐ অবস্থাতেই মারা গেছে।এ আয়াতটি মুনাফিকদের নেতা ও ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালের ব্যাপারে বিশেষভাবে অবতীর্ণ হলেও এটা ব্যাপক ও সাধারণ হুকুম। যার মধ্যেই নিফাক বা কপটতা পাওয়া যাবে তারই ব্যাপারে এই হুকুম প্রযোজ্য হবে। সহীহ বুখারীতে ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই মারা গেলে তার পুত্র আব্দুল্লাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) -এর দরবারে হাযির হয়ে আবেদন করেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার পিতার কাফনের জন্যে আপনার গায়ের জামাটি দান করুন!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার আবেদন মঞ্জুর করে তাকে জামাটি দিয়ে দেন। অতঃপর তিনি নবী (সঃ)-কে তাঁর পিতার জানাযার নামায পড়াবার জন্যে অনুরোধ করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর এ আবেদনও কবুল করেন এবং তার জানাযা পড়াবার জন্যে দাড়িয়ে যান। তখন উমার (রাঃ) তার কাপড়ের অঞ্চল টেনে ধরে বলেনঃ “আপনি এর জানাযার নামায পড়াবেন? অথচ আল্লাহ তা'আলা আপনাকে এ থেকে নিষেধ করেছেন!”রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বলেনঃ “দেখো, আল্লাহ তাআলা আমাকে ইখতিয়ার দিয়ে বলেছেন- ‘তুমি তাদের (মুনাফিকদের) জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর বা নাই কর (সমান কথা), যদি তুমি তাদের জন্যে সত্তর বারও ক্ষমা প্রার্থনা কর তবুও আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। সুতরাং আমি সত্তরেরও অধিক বার ক্ষমা প্রার্থনা করবো।” উমার (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এ লোকটি তো মুনাফিক ছিল।” তথাপিও রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার জানাযার নামায পড়ালেন। তখন মহা মহিমান্বিত আল্লাহ এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। অন্য রিওয়ায়াতে আছে যে, ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর জানাযার নামায পড়ান এবং আমরাও তার সাথে নামায পড়ি। তখন আল্লাহ তা'আলা এই আয়াত অবতীর্ণ করেন।”ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “যখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই মারা যায় তখন তার জানাযার নামায পড়াবার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে ডাকা হয়। তিনি নামাযের জন্যে দাঁড়িয়ে গেলে আমি সফ’ বা সারির মধ্য থেকে বের হয়ে তার সামনে হাযির হই এবং বলি, আপনি কি আল্লাহর শত্রু আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর জানাযার নামায পড়াবেন? অথচ অমুক দিন সে এ কথা বলেছিল এবং অমুক দিন ঐ কথা বলেছিল। তিনি তার কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুচকি হেসে সবই শুনতে থাকেন। অবশেষে তিনি বলেনঃ “হে উমার! আমাকে ছেড়ে দাও। আল্লাহ তাআলা আমাকে ক্ষমা প্রার্থনা করার ইখতিয়ার দিয়েছেন। আমি যদি জানতে পারি যে, সত্তরের অধিকবার ক্ষমা প্রার্থনা করলে তার পাপরাশি ক্ষমা করিয়ে নিতে পারবো তবে অবশ্যই আমি সত্তরেরও অধিকবার তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবো।” এ কথা বলে তিনি তার জানাযার নামায পড়ান, জানাযার সাথেও চলেন এবং দাফন কার্যেও শরীক থাকেন। উমার (রাঃ) বলেনঃ “এরপর আমার এই ঔদ্ধত্যপনার কারণে আমি দুঃখ করতে লাগলাম যে, এসব ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই (সঃ) খুব ভাল জানেন। সুতরাং এরূপ হঠকারিতা করা আমার পক্ষে মোটেই উচিত হয়নি। অল্পক্ষণ পরেই এ দু'টি আয়াত অবতীর্ণ হয়ে যায়। এরপরে শেষ জীবন পর্যন্ত নবী (সঃ) না কোন মুনাফিকের জানাযার নামায পড়িয়েছেন, না তার কবরে এসে দুআ' ইসতিগফার করেছেন।” (হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই মারা যায় তখন তার পুত্র রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কছে এসে আরয করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদি আপনি আমার পিতার জানাযা না পড়ান তবে এটা চিরদিনের জন্যে আমাদের পক্ষে দুর্ভাগ্যের কারণ হবে।” তিনি যখন হাযির হন তখন উবাইকে কবরে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। তিনি বললেনঃ “এর পূর্বেই কেন আমাকে নিয়ে আসনি?” অতঃপর তাকে কবর থেকে উঠিয়ে নেয়া হলো। তখন তিনি তার সারা দেহে নিজের মুখের থুথু দিয়ে দম করলেন। আর তাকে জামাটি পরিয়ে দিলেন। (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) সহীহ বুখারীতে আব্দল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর কাছে এমন সময় আগমন করেন যখন তাকে কবরে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছিল। তিনি তাকে কবর থেকে বের করার নির্দেশ দেন। সুতরাং তাকে কবর হতে বের করা হয়। তিনি তাকে স্বীয় জানুদ্বয়ের উপর রাখেন এবং তার উপর থুথু দিয়ে দম করেন। অতঃপর তাকে নিজের জামাটি পরিয়ে দেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, মৃত্যুর পূর্বে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নিজেই অসিয়ত করে গিয়েছিল যেন তার জানাযা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) পড়িয়ে দেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে বলেনঃ “আমার পিতা অসিয়ত করে গেছেন যে, আপনি যেন তার জানাযার নামায পড়িয়ে দেন। তার এ অসিয়তও রয়েছে যে, আপনার জামা দ্বারা যেন তাকে কাফন পরানো হয়।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) যেই মাত্র তার জানাযা শেষ করেছেন, তখনই জিবরাঈল (আঃ) এ আয়াতগুলো নিয়ে অবতীর্ণ হন। আর একটি রিওয়ায়াতে আছে যে, জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাপড়ের অঞ্চল ধরে তাঁর সালাতের ইচ্ছার সময়েই তাঁকে এ আয়াত শুনিয়ে দেন। কিন্তু এই রিওয়ায়াতটি দুর্বল। আর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই রোগাক্রান্ত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে তার কাছে যাওয়ার নিবেদন করে ডেকে পাঠায়। তিনি তার নিকট গমন করেন। নবী (সঃ) তাকে বলেনঃ “ইয়াহুদীদের প্রেম তোমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।” সে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এখন ধমক ও তিরস্কারের সময় নয়। বরং আমার আকাক্ষা এই যে, আপনি আমার জন্যে দুআ ও ক্ষমা প্রার্থনা করবেন এবং যখন আমি মারা যাব তখন আপনার জামা দ্বারা আমাকে কাফন পরাবেন।” সুতরাং তার মৃত্যুর পর তার ছেলে আব্দুল্লাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট তার জামাটি চাইলেন, যেন তা দ্বারা স্বীয় পিতার কাফন বানাতে পারেন। কোন কোন গুরুজন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে জামা প্রদানের কারণ প্রসঙ্গে বলেছেন যে, আব্বাস (রাঃ) যখন আগমন করেন তখন তার জন্যে একটি জামা চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি খুব লম্বা চওড়া দেহ বিশিষ্ট লোক ছিলেন বলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর জামা ছাড়া অন্য কারো জামা তার গায়ে ঠিক হয়নি। তখন তার জামাটিই তাঁকে দেয়া হয়। এরই প্রতিদান হিসাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর কাফনের জন্যে তার জামাটি দান করেন। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) কোন মুনাফিকের জানাযা পড়াননি এবং কারো জন্যে ক্ষমা প্রার্থনাও করেননি।মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে কোন জানাযার জন্যে ডাকা হতো তখন তিনি ঐ মৃতব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। জনগণ তার সম্পর্কে ভাল মন্তব্য করলে তিনি গিয়ে তার জানাযা পড়াতেন। আর যদি তার সম্পর্কে এরূপ ওরূপ কথা তার কানে আসতো তবে তিনি স্পষ্টভাবে যেতে অস্বীকার করতেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তিকালের পর উমার (রাঃ)-এর নীতি এই ছিল যে, যার জানাযা হুযাইফা (রাঃ) পড়তেন, তিনিও তার জানাযায় শরীক হতেন। আর হুযাইফা (রাঃ) যার জানাযা পড়তেন না, তিনিও পড়তেন না। কেননা রাসূলুল্লাহ হুযাইফা (রাঃ)-কে মুনাফিকদের নাম নির্দিষ্টভাবে বলে দিয়েছিলেন। ঐ নামগুলো শুধু তাঁরই জানা ছিল। এ জন্যেই তাঁকে “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিশ্বস্তজন” আখ্যা দেয়া হয়েছে। এমন কি একদিন এটাও ঘটেছিল যে, উমার (রাঃ) এক ব্যক্তির জানাযার জন্যে দাঁড়িয়েছেন, এমন সময় হুযাইফা (রাঃ) তাঁকে চিমটি কেটে এ থেকে বিরত রাখেন।মুনাফিকদের ব্যাপারে জানাযা এবং ক্ষমা প্রার্থনা থেকে মুসলিমদেরকে বিরত রাখা এই বিষয়েরই দলীল যে, মুসলিমদের ব্যাপারে এ দুটো বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এতে মৃতদের জন্যেও পূর্ণ উপকার রয়েছে এবং জীবিতদের জন্যেও পূর্ণ প্রতিদান রয়েছে, যেমন বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত। আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি জানাযায় হাযির হয়ে সালাত আদায় করা পর্যন্ত তথায় উপস্থিত থাকে তার জন্যে রয়েছে এক কীরাত (সওয়াব)। আর যে ব্যক্তি দাফন করা পর্যন্ত হাযির থাকে তার জন্যে রয়েছে দু’কিরাত (সওয়াব)।” জিজ্ঞেস করা হলোঃ “কীরাত কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “সবচেয়ে ছোট কীরাত হচ্ছে উহুদ পাহাড়ের মত।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অভ্যাস ছিল এই যে, মৃতব্যক্তির দাফনকার্য শেষ করার পর তিনি তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সাহাবীদেরকে হুকুম করতেনঃ “তোমাদের সাথীর জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং কবরে তার অটল ও স্থির থাকার দুআ কর। এই সময় কবরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।”