38:34 38:40 আয়াতের গ্রুপের জন্য একটি তাফসির পড়ছেন
وَلَقَدْ
فَتَنَّا
سُلَیْمٰنَ
وَاَلْقَیْنَا
عَلٰی
كُرْسِیِّهٖ
جَسَدًا
ثُمَّ
اَنَابَ
۟
قَالَ
رَبِّ
اغْفِرْ
لِیْ
وَهَبْ
لِیْ
مُلْكًا
لَّا
یَنْۢبَغِیْ
لِاَحَدٍ
مِّنْ
بَعْدِیْ ۚ
اِنَّكَ
اَنْتَ
الْوَهَّابُ
۟
فَسَخَّرْنَا
لَهُ
الرِّیْحَ
تَجْرِیْ
بِاَمْرِهٖ
رُخَآءً
حَیْثُ
اَصَابَ
۟ۙ
وَالشَّیٰطِیْنَ
كُلَّ
بَنَّآءٍ
وَّغَوَّاصٍ
۟ۙ
وَّاٰخَرِیْنَ
مُقَرَّنِیْنَ
فِی
الْاَصْفَادِ
۟
هٰذَا
عَطَآؤُنَا
فَامْنُنْ
اَوْ
اَمْسِكْ
بِغَیْرِ
حِسَابٍ
۟
وَاِنَّ
لَهٗ
عِنْدَنَا
لَزُلْفٰی
وَحُسْنَ
مَاٰبٍ
۟۠

৩৪-৪০ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ আমি সুলাইমান (আঃ)-এর পরীক্ষা নিয়েছিলাম এবং তার সিংহাসনের উপর একটি দেহ নিক্ষেপ করেছিলাম অর্থাৎ শয়তানকে। তারপর সে তার সিংহাসনের নিকট ফিরে আসলো। ঐ শয়তানের নাম ছিল সখর বা আসিফ অথবা আসরিওয়া কিংবা হাকীক। এ ঘটনাটি অধিকাংশ মুফাসসির বর্ণনা করেছেন। কেউ বর্ণনা করেছেন বিস্তারিতভাবে এবং কেউ বর্ণনা করেছেন সংক্ষেপে। হযরত কাতাদা (রঃ) ঘটনাটি নিম্নরূপে বর্ণনা করেছেনঃ হযরত সুলাইমান (আঃ)-কে বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করার হুকুম দেয়া হয় এবং তাঁকে বলে দেয়া হয় যে, তিনি যেন ওটা এমনভাবে নির্মাণ করেন যাতে লোহার শব্দও শোনা না যায়। হযরত সুলাইমান (আঃ) সদা চেষ্টা তদবীর চালাতে থাকেন, কিন্তু কারিগর খুঁজে পান না। অতঃপর তিনি শুনতে পান যে, সমুদ্রে একটি শয়তান রয়েছে যার নাম সখর। সে অবশ্যই এর নির্মাণ প্রণালী বলে দিতে পারবে। তিনি নির্দেশ দিলেন যে, যেভাবেই হোক তাকে আমার কাছে হাযির করা চাই। সমুদ্রে একটি প্রস্রবণ ছিল। প্রতি সপ্তাহে এক দিন তাতে পানি উচ্ছসিত হয়ে আসতো। ঐ শয়তান এই পানিই পান করতো। ঐ প্রস্রবণের পানি বের করে নেয়া হলো এবং ওটা সম্পূর্ণ খালি করে দিয়ে পানি আসার মুখ বন্ধ করে দেয়া হলো। অতঃপর ঐ শয়তানের আগমনের নির্দিষ্ট দিনে ওটা মদে পরিপূর্ণ করে দেয়া হলো। ঐ শয়তান এসে অবস্থা দেখে বললোঃ “এতো মজার জিনিসই বটে, কিন্তু এটা হলো জ্ঞানের শত্রু। এর দ্বারা অজ্ঞতার উন্নতি হয়।” সুতরাং সে পান না করেই চলে গেল। কিন্তু যখন কঠিনভাবে পিপাসার্ত হলো তখন এসব কিছু বলা সত্ত্বেও তাকে তা পান করতেই হলো। পান করা মাত্রই তার জ্ঞান লোপ পেয়ে গেল এবং তাকে হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর আংটি দেখানো হলো অথবা তার দুই কাঁধের মাঝে মোহর লাগিয়ে দেয়া হলো। সুতরাং সে শক্তিহীন হয়ে পড়লো। * হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর রাজত্বের মূলে ছিল এই আংটি। এই আংটির বলেই তিনি রাজ্য শাসন করতেন। এ শয়তানকে তার দরবারে হাযির করা হলে তিনি তাকে বায়তুল মুকাদ্দাসের নির্মাণ কার্য পরিচালনা করার নির্দেশ দেন। শয়তান এ কাজে বের হলো এবং হুদহুদ পাখীর ডিমগুলো এনে জমা করলো। অতঃপর ডিমগুলোর উপর শীশা রেখে দিলো। হুদহুদ এসে ডিমগুলো দেখলো এবং চার পাশে ঘুরলো। কিন্তু দেখলো যে, ওগুলো উদ্ধার করা যাবে না। তখন সে উড়ে চলে গেল ও হীরা এনে তা শীশার উপর রেখে শীশাকে কাটতে শুরু করলো। অবশেষে শীশা কেটে গেল এবং সে তার ডিমগুলো নিয়ে চলে গেল। ঐ হীরা নিয়ে নেয়া হলো এবং তা দিয়ে পাথর কেটে কেটে বায়তুল মুকাদ্দাসের নির্মাণ কার্য শুরু করে দেয়া হলো। হযরত সুলাইমান (আঃ) যখন পায়খানা বা গোসলখানায় যেতেন তখন তিনি তার আংটি খুলে রেখে যেতেন। একদিন তিনি গোসলখানায় যাচ্ছিলেন এবং ঐ শয়তান তার সাথে ছিল। ঐ সময় তিনি যাচ্ছিলেন ফরয গোসলের জন্যে। আংটিটা তিনি ঐ শয়তানের কাছেই রেখে দেন। শয়তান তখন ঐ আংটি সমুদে। নিক্ষেপ করে এবং ঐ শয়তান হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর রূপ ধারণ করে তার সিংহাসনে এসে বসে যায়। সব জিনিসের উপর ঐ শয়তানের আধিপত্য লাভ হয়। শুধুমাত্র হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর স্ত্রীদের উপর সে কোন ক্ষমতা লাভ করতে পারেনি। এখন ঐ শয়তানের শাসনামলে বহু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে থাকে। ঐ যুগে সেখানে হযরত উমার (রাঃ)-এর ন্যায় একজন অতি বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি বললেনঃ “এ ব্যক্তিকে পরীক্ষা করা দরকার। আমার মনে হচ্ছে যে, এ ব্যক্তি হযরত সুলাইমান (আঃ) নয়।” সুতরাং তিনি একদিন হযরত সুলাইমান রূপী ঐ শয়তানকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আচ্ছা জনাব! যদি কোন লোক রাত্রে অপবিত্র হয়ে যায় এবং ঠাণ্ডার কারণে সূর্যোদয়ের পূর্বে গোসল না করে তবে বুঝি কোন দোষ নেই?” সে উত্তরে বললোঃ “কখনো না।” চল্লিশ দিন পর্যন্ত সে হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর সিংহাসনের উপর উপবিষ্ট ছিল। অতঃপর সুলাইমান (আঃ) মাছের পেটে তার আংটি প্রাপ্ত হন। আংটি রামাত্রই সব কিছুই তার অনুগত হয়ে যায়। এরই বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে।হযরত সুদ্দী (রঃ) বলেনঃ হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর একশ’টি স্ত্রী ছিল। তাদের মধ্যে একজনের উপর তার খুব বিশ্বাস ও আস্থা ছিল যার নাম ছিল জারাদাহ। যখন তিনি অপবিত্র হতেন বা প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করতে যেতেন তখন ঐ আংটি তিনি তার ঐ স্ত্রীর কাছে রেখে যেতেন। একদিন তিনি আংটিটা তার ঐ স্ত্রীর কাছে রেখে পায়খানায় গিয়েছেন, পিছন হতে একটি শয়তান তাঁরই রূপ ধরে এসে তার স্ত্রীর কাছে আংটিটা চায়। তিনি তাকে তা দিয়ে দেন। শয়তান আংটিটা নিয়েই হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর সিংহাসনে গিয়ে বসে পড়ে। তখন হযরত সুলামাইন (আঃ) পায়খানা হতে এসে স্ত্রীর কাছে আংটি চাইলে তিনি বলেনঃ “এখনই তো আপনি আংটি নিয়ে গেলেন।” স্ত্রীর কথা শুনে হযরত সুলাইমান (আঃ) বুঝে ফেললেন যে, এটা তার উপর আল্লাহর পরীক্ষা।সুতরাং তিনি অত্যন্ত হতবুদ্ধি ও চিন্তিত অবস্থায় প্রাসাদ হতে বেরিয়ে পড়লেন। শয়তান চল্লিশ দিন পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করে। কিন্তু হুকুমের পরিবর্তন দেখে আলেমগণ হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর স্ত্রীদের নিকট আসলেন এবং তাদেরকে বললেনঃ “ব্যাপার কি?" হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর সত্তা সম্পর্কে আমরা সন্দেহের মধ্যে পতিত হয়েছি। যদি ইনি প্রকৃতই সুলাইমান হন তবে বুঝতে হবে যে, তার জ্ঞান লোপ পেয়েছে, অথবা ইনি হযরত সুলাইমান (আঃ) নন। ইনি প্রকৃত সুলাইমান হলে কখনো এরূপ শরীয়ত বিরোধী আহকাম জারী করতেন না। তাদের একথা শুনে তাঁর স্ত্রীরা কাঁদতে লাগলেন। ঐ আলেমগণ সেখান হতে ফিরে এসে সিংহাসনের চারদিকে ঐ শয়তানকে ঘিরে বসে পড়লেন এবং তাওরাত খুলে পড়তে শুরু করলেন। আল্লাহর কালাম শুনে ঐ পাপিষ্ঠ শয়তান পালিয়ে গেল এবং ঐ আংটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করলো। ঐ আংটি একটি মাছ গিলে ফেললো।হযরত সুলাইমান (আঃ) তাঁর ঐ অবস্থাতেই কালাতিপাত করছিলেন। একদা তিনি সমুদ্রের ধারে গমন করেন। তিনি ক্ষুধার জ্বালায় কাতর হয়ে পড়েছিলেন। জেলেদেরকে মাছ ধরতে দেখে তিনি তাদের কাছে একটি মাছ চাইলেন এবং নিজের নামও বললেন। তাকে তার নাম বলতে শুনে জেলেদের একজন ভীষণ রাগান্বিত হয় এবং বলেঃ দেখো, এ ভিক্ষা চাচ্ছে, আবার নাম বলছে ‘সুলাইমান’! এ বলে সে তাকে মারতে মারতে ক্ষত বিক্ষত করে দিলো। আহত হয়ে তিনি সমুদ্রের এক কিনারায় গিয়ে নিজের ক্ষত স্থানের রক্ত ধুতে লাগলেন। জেলেদের কারো কারো মনে দয়ার সঞ্চার হলো। তারা বললোঃ “কেন তুমি ভিক্ষুক বেচারাকে মারলে? যাও, মাছ দুটি তাকে দিয়ে এসো। সে ক্ষুধার্ত, ভেজে খাবে।” সুতরাং তারা দুটো মাছ তাঁকে দিলো। মাছ দুটো পেয়ে তিনি রক্ত ও যখমের কথা ভুলে গেলেন এবং তাড়াতাড়ি মাছ দুটো কাটতে বসলেন। আল্লাহর কি মহিমা! মাছের পেটে তিনি তাঁর ঐ আংটি পেয়ে গেলেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এবং অঙ্গুলিতে ঐ আংটি পরে নিলেন। তৎক্ষণাৎ পক্ষীকুল এসে তাঁকে ছায়া করলো এবং ঐ লোকগুলো তাকে চিনে ফেললো। তারা তাঁর সাথে যে দুর্ব্যবহার করেছে সে জন্যে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলো। তিনি বললেনঃ “এ সবই আল্লাহর কাজ। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার উপর এক পরীক্ষা ছিল।” অতঃপর তিনি গিয়ে স্বীয় সিংহাসনে উপবেশন করলেন এবং নির্দেশ দিলেনঃ “ঐ শয়তানকে যেখানেই পাও সেখান থেকেই ধরে এনে বন্দী করে দাও।” সুতরাং তাকে বন্দী করে দেয়া হলো। তিনি তাকে লোহার একটি সিন্দুকে ভরে তাতে তালা লাগিয়ে দিয়ে ওর উপর মোহর লাগিয়ে দিলেন। অতঃপর ঐ সিন্দুককে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হলো। সে কিয়ামত পর্যন্ত সেখানেই বন্দী থাকবে। তার নাম ছিল হাকীক।হযরত সুলাইমান (আঃ) দুআ করেছিলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমন এক রাজ্য দান করুন যার অধিকারী আমি ছাড়া কেউ না হয়। তার এ দু'আও কবুল করা হয় এবং বাতাসকে তাঁর অনুগত করে দেয়া হয়। হযরত মুজাহিদ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আসিফ নামক শয়তানকে হযরত সুলাইমান (আঃ) একবার জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমরা কিভাবে মানুষকে ফিত্রায় ফেলে থাকো?” সে আরয করলোঃ “আমাকে একটু আপনার আংটিটা দিন আমি আপনাকে এখনই তা দেখিয়ে দিচ্ছি।” তিনি তখন তাকে তার আংটিটা দিলেন। সে আংটিটা সমুদ্রে নিক্ষেপ করলো এবং নিজে সে হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর মুকুট ও সিংহাসনের মালিক হয়ে গেল এবং তাঁর পোশাক পরিহিত হয়ে জনগণকে আল্লাহর পথ হতে সরাতে লাগলো (শেষপর্যন্ত)। এটা মনে রাখা দরকার যে, এ সবগুলো হলো বানী ইসরাঈলের বর্ণিত ঘটনা। এগুলোর সবচেয়ে বেশী মুনকার বা অস্বীকার্য ঘটনা হলো ঐটি যা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা। করেছেন এবং যা উপরে বর্ণিত হলো। যাতে হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর স্ত্রী হযরত জারাদার বর্ণনা রয়েছে। তাতে এও আছে যে, এর শেষটা এমন পর্যায়ে। পৌঁছে গিয়েছিল যে, হযরত সুলাইমান (আঃ)-কে তার ছেলেরা পাথর মারতো। আলেমগণ তাঁর স্ত্রীদের কাছে তার সম্পর্কে অনুসন্ধান নিতে গেলে তারা বলেনঃ “হ্যা, আমরাও বুঝেছি যে, এটা সুলাইমান নয়। কেননা, সে হায়েযের অবস্থায় আমাদের নিকট এসে থাকে। শয়তান যখন জানতে পারলো যে রহস্য খুলে গেছে। তখন সে জাদু ও কুফরীর বইগুলো লিখিয়ে নিয়ে সিংহাসনের নীচে পুঁতে দিলো। অতঃপর জনগণের সামনে ঐগুলো বের করিয়ে নিয়ে তাদেরকে বললোঃ “দেখো, এই কিতাবগুলোর বদৌলতেই সুলাইমান (আঃ) শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।” তখন জনগণ হযরত সুলাইমান (আঃ)-কে কাফির বলতে শুরু করে। হযরত সুলাইমান (আঃ) সমুদ্রের ধারে মজুরী করতেন। একবার একটি লোক অনেকগুলো মাছ ক্রয় করে। সে মজুরকে ডাকে। হযরত সুলাইমান (আঃ) সেখানে পৌঁছলে লোকটি তাকে বলেঃ “মাছগুলো উঠিয়ে নিয়ে চল।” তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “মজুরী কত দিবে?" উত্তরে সে বললোঃ “একটি মাছ। তোমাকে দিয়ে দিবো।” তিনি তখন মাছের ঝুড়িটি মাথায় উঠিয়ে নিয়ে লোকটির বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দিলেন। লোকটি তাঁকে একটি মাছ দিয়ে দিলো।তিনি মাছটি গ্রহণ করলেন এবং ওর পেট কেটে দিলেন। পেট কাটা মাত্রই ঐ আংটিটি বেরিয়ে আসলো। ওটা অঙ্গুলিতে পরা মাত্রই সমস্ত শয়তান, দানব ও মানব তার অনুগত ও বশীভূত হয়ে গেল এবং দলবদ্ধ হয়ে তার সামনে হাযির হয়ে গেল। তিনি রাজ্যের উপর আধিপত্য লাভ করলেন এবং ঐ শয়তানকে তিনি কঠিন শাস্তি দিলেন। এর ইসনাদ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) পর্যন্ত রয়েছে। এর সনদ সবল বটে, কিন্তু এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) আহলে কিতাব হতে গ্রহণ করেছেন। এটাও ঐ সময় বলা হবে যখন আমরা মেনে নিবো যে, এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি। আহলে কিতাবের একটি দল হযরত সুলাইমান (আঃ)-কে নবী বলে স্বীকার করতো না। এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই যে, এই জঘন্য কাহিনী ঐ ভ্রষ্ট দলটিই বানিয়ে নিয়েছে। এতে তো ঐ সব কথাও রয়েছে যেগুলো সম্পূর্ণরূপেই মুনকার বা অস্বীকার্য। বিশেষ করে ঐ শয়তানের হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর স্ত্রীদের নিকট যাওয়া কোনক্রমেই স্বীকার করা যেতে পারে না। অন্যান্য ইমামরাও এ ধরনেরই কাহিনী বর্ণনা করেছেন বটে, কিন্তু এটাকে সবাই অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন যে, জ্বিন হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর স্ত্রীদের নিকট যেতে পারেনি এবং নবীর ঘরের স্ত্রীদের পবিত্রতা, নিষ্কলুষতা ও সতীত্বের চাহিদাও এটাই। আরো বহু লোক এই ঘটনাকে খুবই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সবারই মূল এটাই যে, ওগুলো বানী ইসরাঈল ও আহলে কিতাব হতে নেয়া হয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।ইয়াহইয়া ইবনে আবি উরূবা শায়বানী (রঃ) বলেন যে, হযরত সুলাইমান (আঃ) তাঁর আংটিটি আসকালান নামক স্থানে পেয়েছিলেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত তিনি বিনীতভাবে পদব্রজে গিয়েছিলেন।ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর কুরসী সম্বন্ধে হযরত কা'ব আহবার (রাঃ) হতে একটি বিস্ময়কর খবর পরিবেশন করেছেন। আবু ইসহাক মিসরী (রঃ) বলেন যে, যখন হযরত কাব আহবার (রাঃ) ইরামু যাতিল ইমাদ এর ঘটনার বর্ণনা শেষ করেন তখন হযরত মুআবিয়া (রাঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে আবু ইসহাক (রাঃ)! হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর কুরসীর বর্ণনাও একটু করুন।” তখন তিনি বলেনঃ “ওটা হাতীর দাঁতের তৈরী ছিল। তাতে মণি, ইয়াকূত, যবরজদ এবং মুক্তা বসানো ছিল। ওর চতুর্দিকে সোনার খেজুর গাছ বানানো ছিল এবং ওর গুচ্ছগুলোও ছিল মুক্তার তৈরী। কুরসীর ডান দিকে যে খেজুর গাছগুলো ছিল ওগুলোর মাথার উপর সোনার ময়ূর নির্মিত ছিল এবং বাম দিকের খেজুর গাছের মাথায় ছিল গৃধিনী এবং ওটাও ছিল সোনার তৈরী। ঐ কুরসীর প্রথম সোপানের ডান দিকে সোনার দুটি সানুবর বৃক্ষ ছিল এবং বাম দিকে সোনার দু'টি সিংহ নির্মিত ছিল। সিংহ দুটির মাথার উপর যবরজদ পাথরের দুটি স্তম্ভ ছিল এবং কুরসীর দুই দিকে সোনার তৈরী দু’টি আঙ্গুর গাছ ছিল যেগুলো কুরসীকে ছায়া করতো। ওর গুচ্ছও ছিল লাল মুক্তার তৈরী। আর কুরসীর সর্বোচ্চ সোপানের উপর স্বর্ণ নির্মিত বড় বড় দু’টি সিংহ ছিল। সিংহ দু’টির পেট মিশক ও আম্বর দ্বারা পূর্ণ করা থাকতো। যখন হযরত সুলাইমান (আঃ) কুরসীর উপর আরোহণের ইচ্ছা করতেন তখন সিংহ দু’টি কিছুক্ষণ ধরে ঘুরতে শুরু করতো। ফলে ওগুলোর পেটের মধ্যস্থিত মিশক আম্বরগুলো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তো। তারপর স্বর্ণ নির্মিত দু'টি মিম্বর রেখে দেয়া হতো। একটি মন্ত্রীর জন্যে এবং অপরটি সেই সময়ের সবচেয়ে বড় আলেমের জন্যে অতঃপর কুরসীর সামনে স্বর্ণ নির্মিত আরো সত্তরটি মিম্বর বিছিয়ে দেয়া হতো, যেগুলোর উপর বানী ইসরাঈলের কাযী, তাদের আলেমগণ এবং প্রধানগণ বসতেন। ঐগুলোর পিছনে স্বর্ণ নির্মিত আরো পঁয়ত্রিশটি মিম্বর রাখা হতো যেগুলো খালি থাকতো। হযরত সুলাইমান (আঃ) প্রথম সোপানে পা রাখা মাত্রই কুরসী এই সমুদয় জিনিসসহ ঘুরতে থাকতো। সিংহ তার ডান পা সামনে বাড়িয়ে দিতো এবং গধিনী তার বাম পা বিস্তার করতো। তিনি যখন দ্বিতীয় সোপানে পা রাখতেন। তখন সিংহ তার বাম পা বিস্তার করতো এবং গৃধিনী বিস্তার করতো তার ডান পা। যখন তিনি তৃতীয় সোপানে চড়তেন এবং কুরসীর উপর বসে যেতেন তখন একটা বড় গৃধিনী তাঁর মুকুটটি নিয়ে তাঁর মাথায় পরিয়ে দিতো। অতঃপর কুরসী দ্রুতগতিতে ঘুরতে থাকতো। মুআবিয়া (রাঃ) প্রশ্ন করলেন:“হে আবূ ইসহাক (রাঃ)! এভাবে ঘুরার কারণ কি?” জবাবে তিনি বললেন:“ওটা একটা সোনার স্তম্ভের উপর ছিল। সখর নামক জ্বিন ওটা বানিয়েছিল। ওটা ঘুরে উঠতেই নীচের ময়ূর, গৃধিনী ইত্যাদি সবই উপরে এসে যেতো এবং মাথা ঝুঁকাতো ও পাখা নাড়তো। ফলে তার দেহের উপর মিক-আম্বর বিচ্ছুরিত হতো। তারপর একটি কবুতর তাওরাত উঠিয়ে তার হাতে দিতো যা তিনি পাঠ করতেন।” কিন্তু এ রিওয়াইয়াতটি খুবই গরীব বা দুর্বল।হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর দু'আর উদ্দেশ্য ছিলঃ “হে আল্লাহ! আমাকে আপনি এমন রাজ্য দান করুন যা অন্য কেউ আমার নিকট হতে ছিনিয়ে নিতে না পারে। যেমন এই দেহের ঘটনা যা তার কুরসীর উপর রেখে দেয়া হয়েছিল।এটা অর্থ নয় যে, অন্যকে যেন তাঁর মত রাজ্য দান করা না হয় এটা তাঁর দু'আ ছিল। কিন্তু যে লোকগুলো এই অর্থ নিয়েছেন তা সঠিক বলে মনে হয় না। বরং সহীহ মতলব এটাই যে, তাঁর মত রাজ্য যেন অন্য কোন মানুষকে দেয়া না হয় এটাই তার প্রার্থনা ছিল। আয়াতের শব্দ দ্বারা এটাই জানা যাচ্ছে এবং হাদীসসমূহ দ্বারাও এটাই প্রমাণিত হচ্ছে।সহীহ বুখারীতে এই আয়াতের তাফসীরে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এক দুষ্ট জ্বিন গত রাত্রে আমার উপর বাড়াবাড়ি করেছিল এবং আমার নামায নষ্ট করে দিতে চেয়েছিল। আল্লাহ তা'আলা আমাকে তার উপর ক্ষমতা দান করেছিলেন এবং ইচ্ছা করেছিলাম যে, মসজিদের স্তম্ভের সাথে তাকে বেঁধে রাখবো, যাতে সকালে তোমরা তাকে দেখতে পাও। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমার ভাই হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর দু'আর কথা আমার মনে হয়ে গেল। হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত রাওহ (রাঃ) বলেন যে, এরপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ দুষ্ট জ্বিনকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে ছেড়ে দেন।হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। এমতাবস্থায় আমরা তাকে বলতে শুনলামঃ (আরবী) (আমি তোমা হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি) তারপর তিনি বলেনঃ (আরবী) (তোমার উপর আমি আল্লাহর লা'নত বর্ষণ করছি)। একথা তিনি তিনবার বলেন। অতঃপর তিনি এমনভাবে স্বীয় হাত প্রসারিত করেন যে, যেন কোন জিনিস তিনি নিতে চাচ্ছেন। তাঁর নামায শেষ হলে আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা নামাযে আপনাকে এমন কিছু বলতে শুনলাম যা ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। আর আপনাকে হাত প্রসারিত করতে দেখলাম (ব্যাপার কি?)। তিনি উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহর শত্রু ইবলীস জ্বলন্ত অগ্নি নিয়ে আমার মুখে নিক্ষেপ করার জন্যে এসেছিল। তাই আমি তিনবার (আরবী) বলেছি। তারপর তিনবার তার উপর আল্লাহর লা'নত বর্ষণ করেছি। কিন্তু তখনও সে সরেনি। সুতরাং আমি তাকে বেঁধে ফেলার ইচ্ছা করেছিলাম যাতে সকালে মদীনার ছেলেরা তাকে নিয়ে খেলতে পারে। যদি আমার ভাই হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর দু'আ না থাকতো তবে আমি তাই করতাম।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত আতা ইবনে ইয়াযীদ লাইসী (রঃ) নামায পড়ছিলেন। আবু উবায়েদ (রঃ) তাঁর সামনে দিয়ে গমনের ইচ্ছা করলে তিনি তাকে হাত দ্বারা বাধা দেন। অতঃপর বলেন যে, হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) তার নিকট হাদীস বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন এবং আমিও তার পিছনে ছিলাম। তার কিরআত গড়বড় হয়ে যায়। নামায শেষে তিনি বলেনঃ “যদি তোমরা দেখতে যে, আমি ইবলীসকে ধরে ফেলেছিলাম এবং এমনভাবে তার গলা টিপে ধরেছিলাম যে, তার মুখের ফেনা আমার শাহাদাত ও মধ্যমা অঙ্গুলির উপর পড়েছিল! যদি আমার ভাই হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর দু'আ না থাকতো (যে, তাঁর মত ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অন্য কাউকেও যেন না দেয়া হয়) তবে তাকে সকালে মসজিদের স্তম্ভের সাথে বাধা অবস্থায় পাওয়া যেতো এবং মদীনার বালকেরা তার নাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে বেড়াতো। তোমরা যথা সম্ভব এই খেয়াল রাখবে যে, নামাযের অবস্থায় কেউ যেন তোমাদের সামনে দিয়ে গমন করতে না পারে।” (ইমাম আহমাদ (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)হযরত রাবী'আহ ইবনে ইয়াযীদ ইবনে আবদিল্লাহ দাইলামী (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হই। ঐ সময় তিনি তাঁর ‘অহত' নামক বাগানে অবস্থান করছিলেন এবং একজন কুরায়েশ যুবককে ঘিরে রয়েছিলেন যে ব্যভিচারী ও মদ্যপায়ী ছিল। আমি তাকে বললামঃ আমি জানতে পেরেছি যে, আপনি নাকি নিম্নের হাদীসটি বর্ণনা করে থাকেনঃ “যে ব্যক্তি এক চুমুক মদ্যপান করবে, চল্লিশ দিন পর্যন্ত আল্লাহ তা'আলা তার তাওবা কল করবেন না এবং দুরাচার ব্যক্তি সে-ই যে মায়ের পেটেই দুরাচার হয়। আর যে ব্যক্তি শুধু নামাযের নিয়তে বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদে গমন করে সে পাপ থেকে এমন পবিত্র হয় যে, যেন সে আজই জন্মগ্রহণ করেছে। যে মদ্যপায়ী যুবকটিকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) ধরে রয়েছিলেন সে মদ্যপানের কথা শুনেই তো হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পগারপার হয়ে গেল। অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বললেন, কারো এ অধিকার নেই যে, সে এমন কথার দিকে আমাকে সম্বন্ধযুক্ত করে যা আমি বলিনি। প্রকৃতপক্ষে আমি তো রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে নিম্নরূপ শুনেছিঃ “যে ব্যক্তি এক চুমুক মদ্যপান করে, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামায ককূল হয় না। সে যদি তাওবা করে তবে আল্লাহ তা'আলা তার তাওবা কল করে থাকেন। পুনরায় যদি সে পান করে তবে আবার চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামায কবূল হয় না। আবার যদি তাওবা করে তবে তার তাওবা কবুল হয়। আমার মনে নেই যে, তৃতীয় কি চতুর্থ বারে তিনি বলেছিলেনঃ “আবারও যদি মদ্যপান করে তবে এটা নিশ্চিত যে, তাকে জাহান্নামীদের দেহের রক্ত, পুঁজ, প্রস্রাব ইত্যাদি কিয়ামতের দিন পান করানো হবে।” আর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে আমি বলতে শুনেছিঃ “মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় মাখলুককে অন্ধকারের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তাদের উপর নিজের নূর নিক্ষেপ করেছেন। ঐ দিন যার উপর ঐ নূর পতিত হয়েছে সে তো হিদায়াত প্রাপ্ত হয়েছে। আর যার উপর নূর পড়েনি সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। এ জন্যেই আমি বলি যে, আল্লাহর ইলম অনুযায়ী কলম চলা শেষ হয়ে গেছে বা কলম শুকিয়ে গেছে। আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে আরো শুনেছি:“হযরত সুলাইমান (আঃ) আল্লাহ তাআলার নিকট তিনটি প্রার্থনা করেন। তন্মধ্যে দুটি তিনি পেয়ে গেছেন এবং আমরা আশা করি যে, তৃতীয়টি আমাদের জন্যে রয়েছে। তার প্রথম প্রার্থনা ছিল যে, তার হুকুম যেন আল্লাহর হুকুমের অনুকূলে হয়। এটা আল্লাহ তা'আলা তাকে প্রদান করেন। তাঁর দ্বিতীয় প্রার্থনা ছিল এই যে, আল্লাহ পাক যেন এমন রাজ্য তাকে দান করেন যার অধিকারী তিনি ছাড়া আর কেউ না হয়। মহান আল্লাহ এটাও তাঁকে দেন। তাঁর তৃতীয় প্রার্থনা ছিল এই যে, যে ব্যক্তি শুধু এই মসজিদে নামায পড়ার উদ্দেশ্যেই নিজের ঘর হতে বের হয়, সে যখন ফিরে আসে তখন যেন এমন হয়ে যায় যে, তার মা যেন তাকে আজই প্রসব করেছে। আমরা আশা রাখি যে, এটা আমাদের জন্যে আল্লাহ পাক দিয়েছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)হযরত রাফে ইবনে উমায়ের (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “আল্লাহ তা'আলা নিজের জন্যে হযরত দাউদ (আঃ)-কে একটি ঘর নির্মাণ করতে বলেন। হযরত দাউদ (আঃ) প্রথমে নিজের ঘর বানিয়ে নেন। তখন আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিকট অহী করেনঃ “হে দাউদ (আঃ)! আমার ঘর নির্মাণ করার পূর্বেই তুমি তোমার ঘর বানিয়ে নিলে?” হযরত দাউদ (আঃ) উত্তরে বললেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! এটাই ফায়সালা করা হয়েছিল।” অতঃপর তিনি মসজিদের নির্মাণ কার্য শুরু করেন। দেয়াল গাঁথা সমাপ্ত হলে ঘটনাক্রমে দেয়ালের এক তৃতীয়াংশ ভেঙ্গে পড়ে যায়। তিনি মহামহিমান্বিত আল্লাহর নিকট এ জন্যে অভিযোগ জানালে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “তুমি আমার ঘর তৈরী করতে পারবে না।” হযরত দাউদ (আঃ) তখন। জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! কেন?” উত্তরে আল্লাহ্ পাক বলেনঃ “কেননা, তোমার হাত দ্বারা রক্ত প্রবাহিত হয়েছে।” তিনি আরয করেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! এটাও তো আপনার ইচ্ছা ও ভালবাসার জন্যেই?” মহান আল্লাহ জবাবে বলেনঃ “হ্যা, তা সত্য বটে, কিন্তু তারা আমার বান্দা এবং আমি তাদের উপর দয়া করে থাকি।” আল্লাহ তাআলার এ কথা হযরত দাউদ (আঃ)-এর উপর খুব কঠিন ঠেকে। অতঃপর তার উপর অহী করা হয়ঃ “হে দাউদ (আঃ)! তুমি দুঃখিত ও চিন্তিত হয়ো না। আমি এ মসজিদের নির্মাণ কার্য তোমার পুত্র সুলাইমান (আঃ)-এর দ্বারা সমাপ্ত করাবো।” সুতরাং হযরত দাউদ (আঃ)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর পুত্র হযরত সুলাইমান (আঃ) মসজিদের নির্মাণ কার্যে হাত দেন। নির্মাণ কার্য সমাপ্ত হলে তিনি বড় বড় কুরবানী করেন, কুরবানীর পশু যবেহ করেন এবং বানী ইসরাঈলকে একত্রিত করে তাদেরকে পানাহারে পরিতৃপ্ত করেন। সুতরাং অহী অবতীর্ণ হলোঃ “হে সুলাইমান (আঃ)! তুমি এগুলো করেছো আমাকে সন্তুষ্ট ও খুশী করার জন্যে। সুতরাং তুমি আমার কাছে চাও। যা চাইবে তা-ই পাবে।” হযরত সুলাইমান (আঃ) তখন বললেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমার তিনটি আবেদন আছে। প্রথমঃ আমাকে এমন ফায়সালা বুঝিয়ে দিন যা আপনার মর্জি অনুযায়ী হয়। দ্বিতীয়ঃ আমাকে এমন রাজ্য দান করুন আমার পরে যেন অন্য কেউ এর যোগ্য না হয়। তৃতীয়ঃ এই ঘরে যে শুধু নামাযের নিয়তে আসবে সে যেন এমনভাবে পাপমুক্ত হয় যেন আজই তার মা তাকে প্রসব করেছে। এ তিনটির মধ্যে তো দু'টি আল্লাহ তাকে দান করেছেন এবং আমি আশা করি যে, তৃতীয়টিও দেয়া হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আকওয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে দুআর শুরুতে বলতে শুনেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আমার মহান, পরম দানশীল আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি।” (ইমাম আহমাদ (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত দাউদ (আঃ)-এর ইন্তেকালের পর আল্লাহ তা'আলা তাঁর পুত্র হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর নিকট অহী করেনঃ “আমার কাছে তুমি তোমার প্রয়োজন পূরণের প্রার্থনা কর।” তখন তিনি বললেনঃ “আমাকে এমন অন্তর দান করুন যে আল্লাহকে ভয় করে, যেমন আমার পিতার অন্তর ছিল। আর আমার অন্তরকে এমন করে দিন যেন সে আপনাকে মহব্বত করে যেমন আমার পিতার অন্তর ছিল।” তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আমার বান্দার কাছে আমি ওয়াহী করলাম এবং তাকে আমার কাছে তার প্রয়োজন পূরণের জন্যে প্রার্থনা করতে বললাম, তখন সে তার প্রয়োজনের কথা এই বললো যে, আমি যেন তাকে এমন অন্তর প্রদান করি যে আমাকে ভয় করে এবং আমি যেন তার অন্তরে আমার ভালবাসা সৃষ্টি করে দিই। সুতরাং আমি তাকে এমন রাজ্য দান করবো যার যোগ্য তার পরে অন্য কেউ হবে না।”মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “অতএব আমি তার অধীন করে দিলাম বায়ুকে, যা তার আদেশে, সে যেখানে ইচ্ছা করতো সেখানে মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহিত হতো।” আল্লাহ তাআলা তাকে যা দেয়ার তা দিলেন এবং আখিরাতে তাঁর কোন হিসাব নেই। (এভাবে আবুল কাসেম ইবনে আসাকির তার ইতিহাস গ্রন্থে আনয়ন করেছেন)পূর্বযুগীয় কোন একজন মনীষী হতে বর্ণিত আছে যে, তাঁর নিকট হযরত দাউদ (আঃ) সম্পর্কে খবর পৌঁছেছে যে, তিনি বলেছিলেনঃ “হে আমার মা'বুদ। আমার উপর যেমন আপনি (দয়ালু ও স্নেহশীল) রয়েছেন তেমনই (আমার পুত্র) সুলাইমানের উপরও হয়ে যান।”তখন আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিকট অহী করেনঃ “তুমি (তোমার পুত্র) সুলাইমান (আঃ)-কে বলে দাও যে, সে যেন আমারই হয়ে যায় যেমন তুমি আমারই রয়েছে, তাহলে আমি তারই হয়ে যাবো, যেমন আমি তোমারই রয়েছি।”এরপর বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, যখন হযরত সুলাইমান (আঃ) আল্লাহর প্রেম ও মহব্বতে পড়ে ঐ সুন্দর, প্রিয়, বিশ্বস্ত ও দ্রুতগামী ঘোড়াগুলোকে কেটে ফেললেন তখন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা তাঁকে এগুলো অপেক্ষা বহুগুণে উত্তম জিনিস দান করলেন। অর্থাৎ বায়ুকে তিনি তাঁর অনুগত করে দিলেন, যে বায়ু তার এক মাসের পথ তাঁকে সকালের এক ঘন্টায় অতিক্রম করিয়ে দিতো। অনুরূপভাবে সন্ধ্যায় তিনি এক মাসের পথ অতি অল্প সময়ে অতিক্রম করতেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি সুলাইমান (আঃ)-এর অধীন করে দিয়েছিলাম বায়ুকে যা প্রভাতে এক মাসের পথ অতিক্রম করতো এবং সন্ধ্যায় এক মাসের পথ অতিক্রম করতো।” (৩৪:১২)।মহান আল্লাহ বলেনঃ “শয়তানদেরকেও তার অধীনস্থ করে দিয়েছিলাম, যারা সবাই ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী। তারা বড় বড় উঁচু উঁচু ও লম্বা লম্বা পাকা প্রাসাদ নির্মাণ করতে যা মানবীয় শক্তি বহিভূর্ত ছিল। আর তাদের মধ্যে অনেকে ডুবুরীর কাজ করতো। তারা ডুব দিয়ে সমুদ্রের গভীর তলদেশ হতে মণি-মুক্তা, জওহর ইত্যাদি মহামূল্যবান জিনিস নিয়ে আসতো। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা সুলাইমান (আঃ)-এর ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, মূর্তি, হাওদা সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত বৃহদাকার ডেগ নির্মাণ করতো।” (৩৪:১৩)মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ ‘শৃংখলে আবদ্ধ আরো অনেককে তার অধীন করে দিয়েছিলাম। এরা হয়তো তারাই ছিল যারা হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ করতো কিংবা কাজ কামে অবহেলা করতো অথবা মানুষকে জ্বালাতন করতো ও কষ্ট দিতো।মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘এগুলো হলো আমার অনুগ্রহ, এটা হতে তুমি অন্যকে দিতে অথবা নিজে রাখতে পার। এর জন্যে তোমাকে হিসাব দিতে হবে না।' অর্থাৎ এই যে আমি তোমাকে পূর্ণ সাম্রাজ্য এবং ব্যাপক ক্ষমতা ও আধিপত্য দান করেছি যেমন তুমি প্রার্থনা করেছিলে, সুতরাং তুমি এখন যাকে ইচ্ছা দাও ও যাকে ইচ্ছা বঞ্চিত কর, তোমাকে কোন হিসাব দিতে হবে না। অর্থাৎ তুমি যা করবে তাই তোমার জন্যে বৈধ। তুমি যা চাও তাই ফায়সালা কর, ওটাই সঠিক। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে অধিকার ও স্বাধীনতা দেয়া হলো বান্দা ও রাসূল হওয়ার অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তিনি বন্টন করবেন ও এভাবে তার আদেশ পালন করে যাবেন অথবা তিনি নবী ও বাদশাহ হয়ে যাবেন। যাকে ইচ্ছা প্রদান করবেন এবং যাকে ইচ্ছা বঞ্চিত করবেন। তাঁর কোন হিসাব নেই। এ দু'টোর যে কোন একটি তিনি গ্রহণ করতে পারেন। তখন তিনি হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর সাথে পরামর্শ করেন এবং তাঁর পরামর্শক্রমে প্রথমটিই গ্রহণ করেন। কেননা মর্যাদার দিক দিয়ে এটাই উত্তম, যদিও নবুওয়াত ও রাজত্ব বড় জিনিসই বটে। এজন্যে আল্লাহ তা'আলা হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর পার্থিব মান-মর্যাদার কথা বর্ণনা করার পরই বলেনঃ আর (আখিরাতে) আমার নিকট তার জন্যে রয়েছে উচ্চ মর্যাদা ও শুভ পরিণাম।