৫০-৫৪ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে বলছেনঃ হে রাসূল (সঃ)! তুমি তাদেরকে বলে দাও-আমি এই দাবী কখন করি যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন ভাণ্ডার রয়েছে? আর আমি এই দাবীও করি না যে, আমি ভবিষ্যতের বিষয় অবগত রয়েছি। ভবিষ্যতের জ্ঞানতো একমাত্র আল্লাহ তা'আলারই রয়েছে। তিনি আমাকে যেটুকু জানিয়েছেন আমি শুধু ঐটুকুই জানি। আমি এ কথাও বলি না যে, আমি একজন ফেরেশতা। আমি একজন মানুষ ছাড়া কিছুই নই। আমার বৈশিষ্ট্য শুধু এটুকুই যে, আমার কাছে আল্লাহর অহী বা প্রত্যাদেশ এসে থাকে। আল্লাহ তা'আলা আমাকে এরই মর্যাদা দান করেছেন এবং আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। এ জন্যেই আমি অহী ছাড়া অন্য কিছুর অনুসরণ করি না এবং অহীর সীমা হতে অর্ধ হাতও আগে বাড়ি না।ইরশাদ হচ্ছে- হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি তাদেরকে বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মন কি সমান হতে পারে? অর্থাৎ সত্যের অনুসরণকারী এবং পথভ্রষ্ট ব্যক্তি কি কখনও মান হয়? তোমরা কি এটা চিন্তা করে দেখো না? যেমন তিনি অন্য জায়গায় লেছেনঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তোমার উপর তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে তা যে সত্য এটা যে ব্যক্তি জানে সে কি অন্ধ ব্যক্তির মত হতে পারে? এরপর ঘোষিত হচ্ছে-হে মুহাম্মাদ (সঃ)! এই কুরআনের মাধ্যমে তুমি ঐ লোকদেরকে ভয় প্রদর্শন কর যাদের এই ভয় রয়েছে যে, তাদেরকে আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে এবং এই বিশ্বাস আছে যে, আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন অভিভাবক নেই, আর কোন সুপারিশকারী দ্বারাও কিছুই উপকার হবে না। যারা আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে এবং হিসাবের দিনের ভয় রাখে, আর এই ভয় রাখে যে, তাদেরকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। সেই দিন তাদের জন্যে না কোন বন্ধু থাকবে এবং না কোন সুপারিশকারী থাকবে, যে সুপারিশ করে তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করবে। তাদেরকে সেই দিনের ভয় প্রদর্শন কর যেই দিন আল্লাহ ছাড়া আর কারও হুকুমত চলবে না। এর ফলে হয়তো তারা আল্লাহকে ভয় করবে এবং দুনিয়ায় এমন আমল করবে যা তাদেরকে কিয়ামতের দিনের শাস্তি হতে মুক্তি দেবে এবং প্রতিদান পেলে দ্বিগুণ প্রতিদান পাবে।মহান আল্লাহ বলেনঃ (হে মুহাম্মাদ সঃ!) যারা সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং সেই সময় তাদের চিত্ত সম্পূর্ণরূপে নির্মল থাকে, তুমি তাদেরকে তোমার নিকট থেকে দূর করে দিয়ো না, বরং তাদেরকে তোমার সাহচর্য লাভের সুযোগ দান কর। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) (১৮:২৮)। আল্লাহ পাকের উক্তিঃ -এর ভাবার্থ হচ্ছে- তারা তাঁর ইবাদত করে এবং তাঁর নিকট যাজ্ঞা করে। (আরবী) -এই উক্তি সম্পর্কে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা ফরয নামায’ বুঝানো হয়েছে। (এটা মুজাহিদ (রঃ), হাসান (রঃ) এবং কাতাদারও (রঃ) উক্তি) এটা আল্লাহ তা'আলার (আরবী) -এই উক্তির মতই। অর্থাৎ ‘তোমরা আমার নিকট প্রার্থনা কর, আমি তোমাদের সেই প্রার্থনা ককূল করবো।' (৪০:৬০)(আরবী) (১৮:২৮) অর্থাৎ এই আমলের মাধ্যমে তারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে। আর এই আমল তারা আন্তরিকতার সাথে করে।ইরশাদ হচ্ছে-হে মুহাম্মাদ (সঃ)! না তাদের হিসাব তোমার কাছে নেয়া হবে, না তোমার হিসাব তাদের কাছে নেয়া হবে। যেমন যারা হযরত নূহ (আঃ)-কে বলেছিলঃ “আমরা কি তোমার উপর ঈমান আনবো? অথচ আমাদের যারা নিম্ন শ্রেণীর লোক তারাই তোমার অনুসরণ করছে!’ অদের এ কথার উত্তরে হযরত নূহ (আঃ) তাদেরকে বলেছিলেনঃ “তারা কি আমল করছে তা তো আমার জানা। নেই। তোমাদের যদি তা জানা থাকে তবে তোমরা তা জেনেই থাক, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলাই সব কিছু জানেন এবং তিনিই তাদের হিসাব গ্রহণকারী।”ঘোষিত হচ্ছে-হে মুহাম্মাদ (সঃ)! যদি তুমি তাদেরকে তোমার নিকট থেকে সরিয়ে দাও তবে তুমি অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, কুরাইশদের একটি দল নবী (সঃ)-এর নিকট আগমন করে। ঐ সময় তার কাছে হযরত খাব্বাব (রাঃ), হযরত সুহাইব (রাঃ), হযরত বিলাল (রাঃ) এবং হযরত আম্মার (রাঃ) উপবিষ্ট ছিলেন। তখন তাদের সম্মানিত লোকেরা বললোঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! কওমের এই লোকেরাই কি তোমার নিকট পছন্দনীয়? এরাই কি এমন লোক যে, আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে ছেড়ে তাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন? এখন আমরা তাদের দলে মিলিত থেকে কিভাবে তোমার অনুসরণ করতে পারি? তুমি তাদেরকে তোমার নিকট থেকে সরিয়ে দাও। তাহলে আমরা তোমার অনুসরণ করবো।” তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। এই স্থলে মহান আল্লাহ পাক বলেনঃ এভাবেই আমি এককে অপরের দ্বারা পরীক্ষায় ফেলে থাকি।নবী (সঃ)-এর পাশে ঐ দুর্বল মুমিন লোকগুলোকে দেখে তারা তাঁদের ঘৃণার চোখে দেখেছিল। তাই তারা নবী (সঃ)-কে গোপনীয়ভাবে বলেছিলঃ “আমরা আপনার মজলিসে শরীক থাকতে চাই। তবে গ্রাম্য লোকেরা আমাদের মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত রয়েছে। আরব প্রতিনিধিরা আপনার কাছে যাতায়াত করতে আছে। তারা আমাদেরকে এই নিম্ন শ্রেণীর লোকদের সাথে দেখবে, এতে আমরা লজ্জা বোধ করছি। সুতরাং আমরা যখন আপনার নিকট অবস্থান করবো তখন আপনি এই লোকদেরকে আপনার নিকট থেকে সরিয়ে দিবেন। অতঃপর যখন আমরা আপনার নিকট থেকে চলে যাবো তখন ইচ্ছে করলে আপনি তাদেরকে 'আপনার নিকট বসাতে পারেন।” একথা শুনে নবী (সঃ) তাদেরকে বলেনঃ “আচ্ছা, ঠিক আছে।” তখন তারা বলেঃ “এই চুক্তির উপর আমাদেরকে একটা সনদ লিখে দিন।” তাদের এই কথামত রাসূলুল্লাহ (সঃ) কাগজ আনতে বলেন এবং সনদ লিখবার জন্যে হযরত আলী (রাঃ)-কে ডেকে পাঠান। সেই সময় ঐ দুর্বল মুমিন লোকগুলো এক কোণে বসেছিলেন। ঐ অবস্থায় এই আয়াত অবতীর্ণ হয়, তাতে বলা হয়- হে মুহাম্মাদ(সঃ)! এই লোকদেরকে তোমার নিকট থেকে সরিয়ে দেবে না। তারা আল্লাহকে স্মরণ করে থাকে। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আলীর হাত থেকে কাগজ নিয়ে তা ছুঁড়ে ফেলে দেন। এরপর তিনি ঐ দুর্বল মুমিন লোকদেরকে নিজের কাছে ডেকে নেন। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) তাখরীজ করেছেন এবং ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ)আসবাত ইবনে নাসরের হাদীস থেকে এটা বর্ণনা করেছেন!) এই হাদীসটি গারীব। কেননা এই আয়াতটি মক্কী। আর আকরা ইবনে হাবিস আত্তামীমী এবং উয়াইনা ইবনে হাসন আল ফাযারী হিজরতের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত সা'দ বলেন যে, এই আয়াতটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ছয়জন সাহাবীর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়, যাদের মধ্যে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) রয়েছেন। তিনি বলেনঃ “আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট পৌছার ব্যাপারে একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতাম। তিনি আমাদেরকে তার কাছে বসিয়ে নিতেন। তখন কুরাইশরা বলতোঃ “আপনি আমাদেরকে ছেড়ে এদেরকে আপনার কাছে বসিয়ে নিচ্ছেন।” (এটা ইমাম হাকিম স্বীয় ‘মুসতাদরাক' গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ)-এর শর্তের উপর বলেছেন এবং ইবনে হিব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে এট তাখরীজ করেছেন)ইরশাদ হচ্ছে-তাদের মধ্যে কে কেমন তা আমি পরীক্ষা করে নিয়েছি। এই পরীক্ষার ফলাফল এই ছিল যে, কাফির কুরাইশরা বলতোঃ এরাই কি ঐ সব লোক যে, আমাদেরকে বাদ দিয়ে আল্লাহ তাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন? ব্যাপারটা ছিল এই যে, প্রথম যুগে বেশীর ভাগ ঐসব লোকই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন যারা ছিলেন দুর্বল ও নিম্ন শ্রেণীর লোক। আমীর ও নেতৃস্থানীয়দের খুব কম লোকই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। যেমন হযরত নূহ (আঃ)-এর কওমের নেতৃস্থানীয় লোকেরা তাঁকে বলেছিলঃ “আমরা তো দেখছি যে, নিম্ন শ্রেণীর লোকেরাই আপনার অনুসরণ করছে, কোন সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী লোক। তো আপনার অনুসরণ করছে না। অনুরূপভাবে রোম-সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবূ সুফিয়ান (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলঃ কওমের ধনী ও সম্ভ্রান্ত লোকেরা তাঁর (মুহাম্মাদ সঃ -এর) অনুসরণ করছে, না দরিদ্র লোকেরা? আবু সুফিয়ান (রাঃ) উত্তরে বলেছিলেনঃ “বেশীর ভাগ দুর্বল ও গরীব লোকেরাই তার অনুসরণ করছে। তখন হিরাক্লিয়াস মন্তব্য করেছিলঃ এরূপ লোকেরাই রাসূলদের অনুসরণ করে থাকে। ভাৰাৰ্থ এই যে, কাফির কুরাইশরা ঐ দুর্বল মুমিনদেরকে বিদ্রুপ করতো এবং তাদের উপর কর্তৃত্ব লাভ করলে তাদেরকে কষ্ট দিতো। তাদের কথা এই যে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকেই কেন সুপথ প্রদর্শন করলেন? যে পথে তারা পা রেখেছে সেটা যদি ভালই হয় তবে আল্লাহ তাদেরকেই বা ছাড়লেন কেন? তারা আরো বলতোঃ 'যদি এটা মেনে নেয়া ভাল কাজ হতো তবে এরা আমাদের থেকে কখনও বেড়ে যেতে পারতো না ।যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ যখন তাদের সামনে আমার স্পষ্ট আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন ঐ কাফিররা মুমিনদেরকে বলে- আচ্ছা বল তো তোমাদের দু’দলের মধ্যে ভাল কোন্ দল? অথবা সম্মানিত সম্পদশালী কারা? এর জবাবে আল্লাহ বলেনঃ “তাদের পূর্বে আমি এমন বহু কওমকে ধ্বংস করে দিয়েছি যারা এদের চেয়ে বেশী সম্মানিত, জায়গা জমির মালিক ও আঁকজমকপূর্ণ ছিল।” আর যারা বলেছিলঃ “আমাদের উপর এদেরকে আল্লাহ কেন প্রাধান্য দিয়েছেন? তাদের উত্তরে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “আল্লাহ তা'আলা কি কৃতজ্ঞ, ভাল অন্তরের অধিকারী ও সঙ্কৰ্মশীল লোকদেরকে জানেন না? মহান আল্লাহ এ ধরনের লোকদেরকেই ভাল কাজের তাওফীক দিয়ে থাকেন। কেননা, তিনি সকর্মশীল লোকদের সাথেই রয়েছেন।” সহীহ হাদীসে রয়েছে- ‘আল্লাহ তোমাদের আকৃতি ও রং এর দিকে দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকেই দেখে থাকেন।” (ইমাম মুসলিম (রঃ) হাদীসটিকে নিম্নরূপ শব্দের সাথে তাখরীজ করেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের দেহ ও তোমাদের আকৃতির প্রতি নয়র করেন না)(হে মুহাম্মাদ সঃ!) তুমি ভীতি প্রদর্শন কর ঐ লোকদেরকে যাদের আল্লাহর সামনে হাযির হওয়ার ভয় রয়েছে- এই আয়াত সম্পর্কে এই বর্ণনা রয়েছে যে, বানী আবদে মানাফ গোত্রের কয়েকজন সম্ভ্রান্ত লোক আবু তালিবের নিকট এসে বলেঃ “হে আবু তালিব! যদি আপনার ভ্রাতুস্পুত্র মুহাম্মাদ (সঃ) আমাদের গোলাম ও নিম্ন শ্রেণীর লোকদেরকে তাঁর নিকট থেকে সরিয়ে দিতেন তবে কতই না ভাল হতো! কেননা তারা আমাদের গোলাম ও সেবক। আর তাদের সাথে উঠা বসা করা আমাদের কাছে খুবই কঠিন ঠেকছে। সুতরাং যদি তিনি তাদেরকে তাঁর নিকট থেকে সরিয়ে দেন তবে আমরা তার অনুসরণ করবো এবং তাঁর সত্যতা স্বীকার করবো।” তখন আবু তালিব রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে এসে তা বর্ণনা করেন। হযরত উমার (রাঃ) তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেনঃ “ঠিক আছে, এরূপই করে দেখুন! এর দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য জানা যাবে এবং এর পরে তারা কি করে তা দেখা যাবে। সেই সময় এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ পাক বলেনঃ “আল্লাহ কৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে কি জানেন না? কৃতজ্ঞ বান্দাদের দ্বারা নিম্ন লিখিত লোকদেরকে বুঝানো হয়েছেঃ হযরত বিলাল (রাঃ), হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ), হযরত হুযাইফার (রাঃ) গোলাম হযরত সালিম (রাঃ), হযরত উসাইদের (রাঃ) আযাদকৃত গোলাম ও হযরত ইবনে মাসউদের (রাঃ) মিত্র হযরত সুবাইহা (রাঃ), হযরত মিকদাদ ইবনে আমর (রাঃ), হযরত মাসউদ (রাঃ), হযরত ইবনুল কারী (রাঃ), হযরত ওয়াকিদ ইবনে আবদুল্লাহ হান্যালী (রাঃ), আমর ইবনে আবদি আমর (রাঃ), যুশ শিমালাইন (রাঃ), মুরছিদ ইবনে আবি মুরছিদ (রাঃ) এবং হযরত হামযা ইবনে আবদিল। মুত্তালিব (রাঃ)-এর মিত্র হযরত আবু মুরছিদ আল গানাভী (রাঃ)। আর এই আয়াত কাফির কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় লোক ও তাদের মিত্রদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন হযরত উমার (রাঃ) তড়িৎ গতিতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট গমন করেন এবং নিজের ভুল পরামর্শ দানের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।তাই ইরশাদ হচ্ছে- যখন আমার আয়াতসমূহের উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী লোকেরা তোমার নিকট আগমন করে তখন তাদেরকে বল, তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হাক। অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তাদের প্রতি সালাম জানিয়ে তাদের সম্মান বাড়িয়ে দাও এবং তাদেরকে মহান আল্লাহর ব্যাপক রহমতের সুসংবাদ প্রদান কর। এজন্যেই মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহ নিজের উপর। রহমতকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এরপর তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অজ্ঞানতা ও মূর্খতা বশতঃ কোন খারাপ কাজ করে বসে, অতঃপর সে যদি তাওবা করে নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তবে জানবে যে, তিনি হচ্ছেন ক্ষমাশীল, কৃপানিধান। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যখন আল্লাহ তাআলা মাখলুকের উপর তাকদীর স্থাপন করেন তখন তিনি স্বীয় কিতাব লাওহে মাহফুয়ে লিপিবদ্ধ করেন, যা আরশের উপর রয়েছেঃ “আমার ক্রোধে উপর আমার রহমত জয়যুক্ত থাকবে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ বন আল্লাহ তা'আলা স্বীয় মাখলুকের উপর নির্দেশ জারী করে ফেলবেন তখন তিনি আরশের উপর থেকে কিতাব গ্রহণ করবেন যাতে লিখিত থাকবেঃ আমি আরহামুর রাহিমীন। তারপর তিনি এক বা দুই মুষ্ঠিপূর্ণ মাখলুককে জাহান্নাম থেকে বের করবেন যারা একটিও ভাল কাজ করেনি। আর তাদের চক্ষুদ্বয়ের মধ্যস্থলে মাথার উপর লিখিত থাকবেঃ অর্থাৎ এরা হচ্ছে আল্লাহর আযাদকৃত। (আরবী) আল্লাহ তা'আলার এই উক্তি সম্পর্কে হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) লিখেছেন, “তাওরাত গ্রন্থে আমরা লিখিত পাই যে, আল্লাহ তা'আলা যমীন ও আসমান সৃষ্টি করেন এবং স্বীয় একশ'টি রহমতও সৃষ্টি করেন, আর এটা তিনি মাখলুককে সৃষ্টি করার পূর্বেই সৃষ্টি করেন। তারপর তিনি মাখলুককে সৃষ্টি করেন এবং একশটি রহমতের মধ্যে মাত্র একটি রহমত তিনি মাখলুকের মধ্যে বন্টন করে দেন। আর নিজের মধ্যে তিনি নিরানব্বইটি রহমত রেখে দেন। এই একটি মাত্র রহমতের বরকতেই মানুষ পরস্পরের মধ্যে দয়া ও ভালবাসা দেখিয়ে থাকে, পরস্পর মিলেমিশে বাস করে, উষ্ট্ৰী, গাভী ও ছাগী এই একটি রহমত থেকেই অংশ নিয়ে স্বীয় বাচ্চাদের প্রতি স্নেহ ও মমতা দেখিয়ে থাকে এবং সমুদে দু’টি সাপ পরস্পর মিলে জলে অবস্থান করে। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ এইসব রহমত এবং নিজের রহমত সমস্তই স্বীয় পাপী বান্দাদের জন্যে ব্যবহার করবেন। এই বিষয়ে বহু হাদীস বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ বান্দাদের উপর আল্লাহর কি হক রয়েছে তা কি তোমরা জান? অতঃপর তিনি বলেনঃ “বান্দাদের উপর আল্লাহর হক এই যে, তারা তাঁরই ইবাদত করবে এবং তার সাথে কাউকে শরীক করবে না।” তারপর তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “আল্লাহর উপর তার বান্দাদের কি হক রয়েছে তা কি তোমরা অবগত আছ? তা এই যে, তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তাদেরকে শাস্তি দেবেন না।”
٠%