৯১-৯২ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ পাক বলেন-তারা যখন আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে অবিশ্বাস করলো তখন বুঝা গেল যে, তারা আল্লাহ তা'আলার মর্যাদার হক আদায় করলো না। আবদুল্লাহ ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন যে, এই আয়াতটি কুরায়েশদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। আবার একথাও বলা হয়েছে যে, এটা ইয়াহুদীদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। অথবা এটা অবতীর্ণ হয় মালিক ইবনে সায়েফের ব্যাপারে। এই নির্বোধদের উক্তি এই যে, আল্লাহ তাআলা কোন মানুষের উপর কিতাব অবতীর্ণ করেননি। শানে নুযূল হিসেবে প্রথম উক্তিটিই সঠিকতম। কেননা, এ আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। আর ইয়াহূদীরা তো এ কথা বলতো না যে, মানুষের উপর কোন কিতাব অবতীর্ণ হয়নি। কেননা, তারা তো এটা স্বীকার করে যে, তাওরাত হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। মক্কার অধিবাসী কুরায়েশ ও আরবরাই মুহাম্মাদ (সঃ)-কে অস্বীকার করতো। তাদের দলীল ছিল এই যে, মুহাম্মাদ (সঃ) একজন মানুষ এবং মানুষের উপর কিতাব অবতীর্ণ হয় না। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি মানুষের মধ্য হতে কারও উপর অহী পাঠাই- তুমি তাদেরকে (কুফরী থেকে) ভয় প্রদর্শন কর, এতে কি মানুষেরা বিস্ময় বোধ করে?” (১০:২) আরও ইরশাদ হচ্ছে- (আরবী) অর্থাৎ “যখন তাদের কাছে হিদায়াত পৌঁছে তখন যে জিনিস তাদেরকে ঈমান আনয়নে বাধা দেয় তা হচ্ছে এই যে, তাদের কথা ছিল- আল্লাহ কি কোন মানুষকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন? হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে বল, ফেরেশতারা যদি ভূ-পৃষ্ঠে চলাফেরা করার প্রাণী হতো তবে কোন ফেরেশতাকেই আমি রাসূল করে পাঠাতাম।” (১৮:৫৫) এখন আল্লাহ পাক এখানে বলেনঃ আল্লাহর যেরূপ মর্যাদা দেয়া উচিত তা তারা দেয়নি। অর্থাৎ তারা বলে দিলো যে, আল্লাহ কোন মানুষের উপর কিছু অবতীর্ণ করেননি। হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে বলে দাও- আল্লাহ মূসা (আঃ)-এর উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছিলেন। যে কিতাব লোকদের উপর নূর ও হিদায়াত রূপে প্রমাণিত হয়েছে। হযরত মূসা (আঃ) কর্তৃক পেশকৃত কিতাব তাওরাত' কার দ্বারা অবতীর্ণ করা হয়েছে? তোমরা এবং সবাই একথা অবগত যে, মূসা ইবনে ইমরান (আঃ)-এর কিতাব আল্লাহ কর্তৃকই অবতারিত ছিল। যদ্দ্বারা মানুষ হিদায়াতের আলো লাভ করতো এবং সন্দেহের অন্ধকারে সোজা সরল পথ খুঁজে পেতো।মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা তাওরাতকে খণ্ড খণ্ড করে বিভিন্ন পত্রে রেখেছো, কিন্তু তাতে লিখতে গিয়ে নিজেদের পক্ষ থেকে পরিবর্ধনও করতে রয়েছে। আর বলতে রয়েছে, এটাও আল্লাহরই আয়াত। এজন্যে আল্লাহ পাক বলেন, কিছু কিছু প্রকৃত আয়াত প্রকাশ করছো বটে, কিন্তু অধিকাংশ আয়াতকেই তোমরা গোপন করছে।আল্লাহ তা'আলার উক্তি- এই কিতাবের মাধ্যমে তোমরা এমন কিছু জেনেছো যা তোমরাও জানতে না এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা। অর্থাৎ হে কুরায়েশের দল! কে এই কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, যাতে অতীতের সংবাদ রয়েছে এবং ভবিষ্যত বাণীও বিদ্যমান আছে যেগুলো না তোমরা জানতে, না তোমাদের বাপ-দাদারা জানত। কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এই সম্বোধন আরবের মুশরিকদেরকে করা হয়েছে। আর মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এই সম্বোধন মুসলমানদেরকেই করা হয়েছে। যখন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ এই প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই প্রদান কর যে, এই কুরআন আল্লাহই অবতীর্ণ করেছেন। এটা হচ্ছে ওটাই যা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন এবং এই শব্দের তাফসীরে এটাই নির্দিষ্ট। তাফসীর এই রূপ নয় যা পরবর্তী গুরুজনরা বলেছেন। তা এই যে, (আরবী) -এর অর্থ হচ্ছে- হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তাদের প্রতি তোমার সম্বোধন এটা ছাড়া নয় যে, এই শব্দ শুধু একক শব্দ, অর্থাৎ শব্দটি হচ্ছে ‘আল্লাহ'। এতে এটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে যে, একটা একক শব্দ বাক্যও হতে পারে যা (আরবী) বা অমিশ্রিত শব্দ। কিন্তু একক শব্দকে আরবী অভিধানে (আরবী) মনে। করা হয় এবং ওর উপর (আরবী) বা নীরবতা চলতে পারে না। আল্লাহ পাকের উক্তি- হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে বাতিল ধারণার উপর ছেড়ে দাও, তারা খেলা করতে থাকুক । অবশেষে মৃত্যুর পর তাদের বিশ্বাসের চক্ষু খুলে যাবে এবং পরিশেষে তারা আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করবে।মহান আল্লাহর উক্তি- এই কুরআন হচ্ছে অত্যন্ত বরকতময় এবং এই কিতাব পূর্ববর্তী সমস্ত কিতাবকে সত্যায়িত করে থাকে। এ কিতাব তিনি এই জন্যেই অবতীর্ণ করেছেন যেন তুমি এর মাধ্যমে মক্কা ও তার চতুষ্পর্শ্বে বসবাসকারী আরব গোত্রগুলোকে এবং আরব ও আজমের আদম সন্তানদেরকে কুফর ও শিরকের ভয়াবহ পরিনাম থেকে ভীতি প্রদর্শন করতে পার। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছে (আরবী) অর্থাৎ “হে রাসূল (সঃ)! তুমি বলে দাও- হে লোক সকল! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সকলের প্রতি রাসূল রূপে প্রেরিত হয়েছি, যেন আমি তোমাদেরকে সতর্ক করি এবং তাদেরকেও, যাদের কাছে আমার পয়গাম পৌঁছে যাবে।” (৭:১৫৮) মহান আল্লাহ আরও বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “দলসমূহের মধ্য থেকে যারা এর সাথে কুফরী করবে, তাদের জন্যে জাহান্নামের অঙ্গীকার রয়েছে।”(১১৪ ১৭) আল্লাহ তা'আলা আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ঐ সত্তা কল্যাণময় যিনি স্বীয় বান্দার উপর (মুহাম্মাদ সঃ -এর উপর) ফুরকান (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন, যেন সে সারা বিশ্ববাসীর জন্যে ভয় প্রদর্শক হয়ে যায়।” (২৫:১) আল্লাহ পাক আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! তুমি আহলে কিতাব ও মূর্খদেরকে (মুশরিকদেরকে) বলে দাও- তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করলে? যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে তবে সুপথ লাভ করবে, আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে (তুমি সে জন্যে দায়ী নও) তোমার দায়িত্ব শুধু পৌঁছিয়ে দেয়া। আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল।” (৩:২০) সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমাকে এমন পাঁচটি জিনিস দেয়া হয়েছে যেগুলো আমার পূর্ববর্তী নবীদের কাউকেই দেয়া হয়নি। ওগুলোর মধ্যে একটি এই যে, প্রত্যেক নবী নির্দিষ্টভাবে নিজের কওমের নিকটেই প্রেরিত হয়েছিলেন, আর আমি সারা বিশ্ববাসীর কাছেই প্রেরিত হয়েছি।” এজন্যেই আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে তারা এই কিতাবের (কুরআনের) উপরও বিশ্বাস রাখে যা আমি (হে মুহাম্মাদ সঃ) তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি।” মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা এমনই মুমিন যে, তারা স্বীয় নামাযসমূহের পাবন্দী করে।” অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যেমনভাবে সময়মত নামায আদায় করা তাদের উপর ফরয করে দিয়েছেন তারা সেভাবেই নামায আদায় করে থাকে।
0%