৪৯-৫০ নং আয়াতের তাফসীরএই আয়াতসমূহে মহান আল্লাহ হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর সন্তানদেরকে লক্ষ্য করে বলছেন যে, আল্লাহর সেই অনুগ্রহের কথা তাদের স্মরণ করা উচিত যে, তিনি তাদেরকে ফিরআউনের জঘন্যতম শাস্তি হতে রক্ষা করেছেন। অভিশপ্ত ফির'আউন স্বপ্নে দেখেছিল যে, বায়তুল মুকাদ্দাসের দিক হতে এক আগুন জ্বলে উঠে মিসরের প্রত্যেক কিবতীর ঘরে প্রবেশ করেছে, কিন্তু তা বানী ইসরাঈলের ঘরে যায়নি। এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছিল এই যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এমন একটি ছেলে জন্মগ্রহণ করবে যার হাতে তার অহংকার চূর্ণ হয়ে যাবে এবং তার খোদায়ী দাবীর চরম শাস্তি তার হাতেই হবে। এজন্যেই সেই অভিশপ্ত ব্যক্তি চারদিকে এ নির্দেশ জারী করে দিল যে, বানী ইসরাঈলের ঘরে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, সরকারী লোক যাচাই করে দেখবে। যদি পুত্র সন্তান হয় তবে তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলা হবে। আর যদি মেয়ে সন্তান হয় তবে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। আরও ঘোষণা করলো যে, বানী ইসরাঈলের দ্বারা কঠিন ও ভারী কাজ করিয়ে নেয়া হবে এবং তাদের মাথার উপরে ভারী ভারী বোঝা চাপিয়ে দেয়া হবে। এখানে শাস্তির তাফসীর পুত্র সন্তান হত্যার দ্বারা করা হয়েছে। সূরা-ই-ইবরাহীমে একের সংযোগ অন্যের উপর করা হয়েছে। এর পূর্ণ ব্যাখ্যা ইনশাআল্লাহ সূরা-ই কাসাসের প্রথমে দেয়া হবে।(আরবি)-এর অর্থ হচ্ছে ‘লাগিয়ে দেয়া এবং সদা করতে থাকা। অর্থাৎ তারা বরাবরই কষ্ট দিয়ে আসছিল। যেহেতু এই আয়াতের পূর্বে বলেছিলেন যে, তারা যেন আল্লাহর পুরস্কার রূপে দেয়া নিয়ামতের কথা স্মরণ করে। এজন্যে ফিরআউনীদের শাস্তিকে ব্যাখ্যা হিসেবে পুত্র সন্তান হত্যা দ্বারা বর্ণনা করেছেন। আর সূরা-ই-ইবরাহীমের প্রথমে বলেছিলেন যে, তারা যেন আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ করে এজন্যে সেখানে সংযোগের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন, যাতে নিয়ামতের সংখ্যা বেশী হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন শাস্তি হতে এবং পুত্র সন্তান হত্যা হতে তাদেরকে হযরত মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে রক্ষা করেছিলেন। মিসরের আমালীক কাফির বাদশাহদেরকে ফির'আউন বলা হতো। যেমন রূমের কাফির বাদশাহকে কাইসার, পারস্যের কাফির বাদশাহকে কিসরা, ইয়ামনের কাফির বাদশাহকে ‘তুব্বা, হাবশের কাফির বাদশাহকে নাজ্জাসী এবং ভারতের কাফির বাদশাহকে বলা হতো বাতলীমুস। ঐ ফিরআউনের নাম ছিল ওয়ালিদ বিন মুসআব বিন রাইহান। কেউ কেউ মুসআব বিন রাইয়ানও বলেছেন। আমালীক বিন আউদ বিন আরদাম বিন সাম বিন নূহের সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার কুনইয়াত ছিল আবু মাররাহ্। প্রকৃতপক্ষে সে ইসতাগার ফারসীদের মুলোদ্ভূত ছিল। তার উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক। আল্লাহ পাক বলেন যে, এ মুক্তি দেয়ার মধ্যে তাঁর পক্ষ হতে এক অতি নিয়ামত ছিল। (আরবি)-এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে নিয়ামত। পরীক্ষা ভাল ও মন্দ উভয়ের সাথেই হয়ে থাকে। কিন্তু (আরবি)-এর শব্দ সাধারণতঃ মন্দের পরীক্ষার জন্যে এবং (আরবি) এর শব্দ মঙ্গলের পরীক্ষার জন্যে এসে থাকে। এটা বলা হয়েছে যে, এতে অর্থাৎ ঐ শাস্তি এবং পুত্র সন্তানদের হত্যা করার মধ্যে তাদের পরীক্ষা ছিল। কুরতবী (রঃ) দ্বিতীয় ভাবকে জমহরের কথা বলে থাকেন। তাহলে এতে ইঙ্গিত হবে যবাহ ইত্যাদির দিকে এবং (আরবি)-এর অর্থ হবে মন্দ। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেছেন যে, তিনি তাদেরকে ফির'আউনের দল হতে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। তারা হযরত মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিল এবং ফির'আউন তাদেরকে ধরার জন্যে দলবলসহ বেরিয়ে পড়েছিল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা সমুদ্রকে বিভক্ত করে দিয়ে তাদেরকে পার করেছিলেন এবং তাদের চোখের সামনে ফিরআউনের তার সৈন্যবানিহীসহ ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। এসব কথার বিস্তারিত বর্ণনা ইনশাআল্লাহ সূরা-ই-শু’রার মধ্যে আসবে।আমর বিন মাইমুন আওদী (রঃ) বলেন যে, যখন হযরত মূসা (আঃ) বানী ইসরাঈলকে নিয়ে বের হন তখন ফিরআউন এ সংবাদ পেয়ে তার লোকজনকে বলে যে, তারা যেন মোরগের ডাকের সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ে এবং তাদেরকে ধরে যেন হত্যা করে দেয়। কিন্তু সেই রাতে সকাল পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমে মোরগ ডাকেনি। অতঃপর মোরগের ডাক শোনা মাত্রই ফিরআউন একটি ছাগী যবাহ্ করে এবং বলেঃ আমি এর কলিজা খাওয়ার পূর্বেই ছয় লাখ কিবতী সৈন্য আমার সামনে হাজির চাই। সুতরাং সৈন্যরা হাজির হয়ে গেল। ফিরআউন এই দলবল নিয়ে বড়ই জাকজমকের সাথে বানী ইসরাঈলকে ধ্বংস করার জন্যে বেরিয়ে বানী ইসরাঈলকে তারা সমুদ্রের ধারে পেয়ে গেল। এখন বানী ইসরাঈলের নিকট বিরাট পৃথিবী সংকীর্ণ হয়ে পড়লো। পিছনে সরলে ফিরআউনদের তরবারীর নীচে পড়তে হবে, আবার সামনে এগুলে মাছে গ্রাস করে নেবে। সে সময় হযরত ইউসা বিন নূন বললেন যে, হে আল্লাহর নবী (আঃ)! এখন কি করা যায়? তিনি বলেনঃ “আল্লাহর নির্দেশ আগে আগে রয়েছে। এটা শোনা মাত্রই তিনি ঘোড়া নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু গভীর পানিতে যখন ঘোড়া ডুবতে লাগলো তখন তিনি ধারে ফিরে আসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে মূসা! প্রভুর সাহায্য কোথায়? আমরা আপনাকেও মিথ্যাবাদী মনে করি না, প্রভুকেও নয়।' তিনবার তিনি এরকমই করলেন। এখন হযরত মূসা (আঃ)-এর নিকট ওয়াহী আসলোঃ “হে মূসা (আঃ)! তোমার লাঠিটি নদীর উপর মার।' লাঠি মারা মাত্রই পানির মধ্যে রাস্তা হয়ে গেল এবং পানি পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে গেল। হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর অনুসারীগণ ঐ রাস্তা দিয়ে পার হয়ে গেলেন। তাদেরকে এভাবে পার হতে দেখে ফিরআউন ও তার সঙ্গীরা এ পথে তাদের ঘোড়া ছেড়ে দিল। যখন সবাই তার মধ্যে এসে গেল তখন আল্লাহ পানিকে মিলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। দুই দিকের পানি একাকার হয়ে গেল এবং তারা সবাই ডুবে মরে গেল। বানী ইসরাঈল নদীর অপর তীরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ক্ষমতার এ দৃশ্য স্বচক্ষে অবলোকন করলো। তারা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলো। নিজেদের মুক্তি এবং ফিরআউনের ধ্বংস তাদের জন্য খুশীর কারণ হয়ে গেল। এও বর্ণিত আছে যে, এটা আশূরার দিন ছিল। অর্থাৎ মহরম মাসের ১০ তারিখ।মুসনাদ-ই-আহমাদের হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) মদীনায় এসে যখন দেখলেন যে, ইয়াহূদীরা আশূরার রোযা রয়েছে, তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এইদিন তোমরা রোযা রাখ কেন? তারা উত্তরে বলেঃ ‘এজন্যে যে, এ কল্যাণময় দিনে বানী ইসরাঈল ফিরআউনের হাত হতে মুক্তি পেয়েছিল এবং তাদের শত্রুরা ডুবে মরেছিল। তারই কৃতজ্ঞতা প্রকাশরূপে হযরত মূসা (আঃ) এ রোযা রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তোমাদের অপেক্ষা মূসা (আঃ)-এর আমিই বেশী হকদার। সুতরাং রাসূলুল্লাহও (সঃ) ঐ দিন রোযা রাখেন এবং জনগণকে রোযা রাখতে নির্দেশ দেন। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও সুনান-ই- ইবনে মাজার মধ্যেও এ হাদীসটি আছে। অন্য একটি দুর্বল হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “ঐ দিন আল্লাহ্ তা'আলা বানী ইসরাঈলের জন্যে পানি উঁচু করে দিয়েছিলেন। এ হাদীসের বর্ণনাকারী জায়দুলআমা দুর্বল এবং তার শিক্ষক ইয়াযীদ রেকাশী তার চেয়েও বেশী দুর্বল।