১৬-১৮ নং আয়াতের তাফসীর হযরত ইউসুফকে (আঃ) অন্ধকার কূপে ফেলে দেয়ার পর তাঁর ভ্রাতাগণ কি করেছিল আল্লাহ তাআ’লা এখানে সেই খবরই দিচ্ছেন। গুপ্তভাবে তারা ছোট ভাই, আল্লাহর নিস্পাপ নবী এবং পিতার চোখের মণি হযরত ইউসুফের (আঃ) উপর অবিচার ও অত্যাচারের পাহাড় ভেঙ্গে দিয়ে রাত্রে তারা বাহ্যিকভাবে দুঃখের ভান করে কাঁদতে কাঁদতে পিতার নিকট আগমন করে। আর ইউসুফকে (আঃ) হাত ছাড়া করে দেয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেঃ “হে পিতঃ! আমরা তীরন্দাযী ও দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করি এবং ছোট ভাই ইউসুফকে (আঃ) আমাদের আসবাবপত্রের নিকট রেখে যাই। ঘটনাক্রমে ঐ সময়েই নেকড়ে বাঘ এসে পড়ে এবং তাঁকে খেয়ে ফেলে। এরপর তারা তাদের পিতার কাছে নিজেদের কথা সত্য প্রমাণিত করার জন্যে বললো: “আব্বাজান! এটা এমন একটা ঘটনা যে, তা সত্য বলে মেনে নিতে আপনার বিবেকে বাধছে, পূর্বেই তো আপনার মনে খটকা লেগেছিল এবং ঘটনাক্রমে তা ঘটেই গেল। তবুও কিন্তু আপনি আমাদেরকে সত্যবাদী রূপে মেনে নিতে পারছেন না। অথচ আমরা যে সত্যবাদী তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। কিন্তু আমাদেরকে সত্যবাদীরূপে মেনে না নেয়ার ব্যাপারে আপনি একদিক দিয়ে সত্যের উপর রয়েছেন। কেননা, এটা এমনই একটা অস্বাভাবিক ঘটনা যে, এটা দেখে আমরা নিজেরাই বিস্মিত না হয়ে পারি না। এটা ছিল তাদের মৌখিক কথা। এছাড়া একটা মিথ্যা প্রমাণও তারা পেশ করেছিল। অর্থাৎ তারা বকরীর একটা বাচ্চাকে যবাহ করে ওর রক্ত দ্বারা হযরত ইউসুফের (অঃ) জামাটি রঞ্জিত করেছিল। ঐ জামাটি তারা পিতার সামনে হাযির করে বলেছিলঃ “দেখুন! ইউসুফের (আঃ) দেহের রক্ত তার জামায় ভরে রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাআ’লার কি মহিমা যে, তারা সবকিছুই করেছিল, কিন্তু জামাটি ছেদন করতে ভুলে গিয়েছিল। ফলে পিতার কাছে তাদের প্রতারণা ধরা পড়ে যায়। কিন্তু তিনি নিজেকে সামলিয়ে নিলেন এবং স্পষ্টভাবে ছেলেদেরকে তেমন কিছু বললেন না। তথাপি ছেলেরা বুঝে নেয় যে, তাদের পিতার কাছে তাদের ধোকাবাজী ধরা পড়ে গেছে। তাদের পিতা তাদেরকে শুধু বললেনঃ “তোমাদের মন এই কথা বানিয়ে নিয়েছে। যাই হোক, আমি ধৈর্য ধারণ করবো যে পর্যন্ত না আল্লাহ তাআ’লা দয়া পরবশ হয়ে আমার এই দুঃখ দুর করে দেন। তোমরা যে একটা মিথ্যা কথা আমার কাছে বর্ণনা করছে এবং একটা অসম্ভব ব্যাপারের উপর আমাকে বিশ্বাস স্থাপন করতে বলছো তার জন্যে আমি একমাত্র আল্লাহরই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি। যদি তাঁর সাহায্য লাভে আমি সমর্থ হই তবে অবশ্যই দুধ ও পানি পৃথক হয়ে যাবে।হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইউসুফের (আঃ) রক্ত-রঞ্জিত জামাটি দেখে তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব (আঃ) বলেছিলেনঃ “এটা বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার যে, নেকড়ে বাঘে ইউসুফকে (আঃ) খেয়ে ফেললো এবং তাঁর জামাটি রক্তে রঞ্জিত হলো, অথচ তা একটুও ছিড়লো না বা ফাটলো না! যা হোক, আমি ধৈর্যধারণকরবো, যাতে না থাকবে কোন অভিযোগ এবং না থাকবে কোন চিন্তা ও উদ্বেগ।” সাওরী (রঃ) তাঁর কোন এক সহচর হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেনঃ “সবর বা ধৈর্য হচ্ছে তিনটি জিনিষের নাম। (১) নিজের বিপদ আপদের কথা কারো কাছে বর্ণনা না করা। (২) নিজের দুঃখের কাহিনী গেয়ে কারো সামনে ক্রন্দন না করা এবং (৩) নিজেকে পাক পবিত্র মনে না করা।” এখানে ইমাম বুখারী (রঃ) হযরত আয়েশার (রাঃ) ঐ ঘটনাটির পূর্ণ হাদীস বর্ণনা করেছেন, যাতে তাঁর উপর অপবাদ লাগানোর বর্ণনা রয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেনঃ “আল্লাহর শপথ! আমার এবং আপনাদের দৃষ্টান্ত হযরত ইউসুফের (আঃ) পিতার মতই বটে। তিনি বলেছিলেনঃ “এখন পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছে সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল।”